কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টি কখন, কেন ও কিভাবে তৈরি হয়?
@মো: মোশারফ হোসাইন
আকাশে শুরু হয়েছে এলোমেলো মেঘের ছোটাছুটি এবং অনেক এলাকায় শুরু হয়েছে কালবৈশাখী ঝড়, অনেক এলাকায় পতিত হয়েছে ভয়াবহ শিলা বৃষ্টি। বছরের অন্য সময় এমন ঝড় কমই হয়ে থাকে। সাধারণভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে বৈশাখেই কেন এত ঝড়-ঝঞ্ঝাট হয়। একটু জানার চেষ্টা করি।
‘কাল’ শব্দের অর্থ ঋতু। আবার কালো বর্ণকেও বোঝানো হয়ে থাকে। কালবৈশাখীকে কখনও কখনও ‘কালোবৈশাখী’ নামেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে যার অর্থ কালো বর্ণের বৈশাখী মেঘ। ঘন, কালো বর্ণের মেঘ ও ঝঞ্ঝা এবং এর ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির জন্যই এ নামকরণ। চৈত্রের শেষে এবং বৈশাখ মাসে সূর্য দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের ওপর খাড়াভাবে কিরণ দেয়। ফলে এ অঞ্চলের বায়ু সকাল থেকে দুপুরের রোদের তাপে হালকা হয়ে ওপরের দিকে উঠে যায়। এভাবে বিকেলের দিকে এ অঞ্চলে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। একই সময় দেশের উত্তরে অর্থাৎ হিমালয়ের দিকে বায়ুর চাপ বেশি থাকে। তাই উচ্চচাপের উত্তরাঞ্চল থেকে বায়ু প্রবল বেগে দক্ষিণ দিকে নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে ধাবিত হয়। উভয় বায়ুর সংঘর্ষে যে প্রবল ঝড়ের সৃষ্টি হয়, তাকে কালবৈশাখী ঝড় বলা হয়।
কালবৈশাখী ঝড় দীর্ঘ সময় নিয়ে সৃষ্টি হলেও কিন্তু এর স্থায়িত্বকাল স্বল্পতর। একটি সম্পূর্ণ ঝড় তৈরি হয়ে পূর্ণতা লাভের পর ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট পর্যন্ত এর তীব্রতা সর্বোচ্চ থাকে। তারপর তা আস্তে আস্তে হ্রাস পেতে থাকে। তবে কখনো কখনো এ ঝড় এক ঘন্টারও বেশি সময় স্থায়ী হয়। কালবৈশাখীর বায়ুর গড় গতিবেগ ঘন্টায় ৪০ থেকে ৬০ কিমি হয়। কোন কোনো ক্ষেত্রে এ গতিবেগ ঘন্টায় ১০০ কিমি-এর বেশিও হতে পারে। কালবৈশাখীর সময় অঝোর ধারায় বৃষ্টিপাত হয়। বিদ্যুৎ চমকানো, বজ্রপাত, অতি দ্রুত হারে তাপমাত্রা হ্রাস আর শিলাপাত কালবৈশাখীর সাধারণ ঘটনা। কালবৈশাখীর সময় উত্তর-পশ্চিমাকাশ কাল করে আসে। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে শেষ বিকেলে এবং সন্ধ্যার পূর্বে কালবৈশাখীর আগমন ঘটে, কিন্তু পূর্বাঞ্চলে সাধারণত সন্ধ্যার পরে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে পূর্বদিকে এবং দক্ষিণ-পুর্ব দিক থেকে আগমন করে থাকে। এ ঋতুতে সকাল বেলাটা মোটামুটি শান্ত থাকে। মধ্যাহ্নের পরে অপরাহ্নে ভূ-পৃষ্ঠ সর্বাধিক উত্তপ্ত হয় এবং বায়ুমন্ডলে পরিচলন স্রোত সৃষ্টিতে ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণতা প্রধান ভূমিকা পালন করায় কালবৈশাখী সাধারণত শেষ বিকেলে শুরু হয়।
কালবৈশাখীর জীবনচক্রকে তিনটি ধাপ বা পর্যায়ে বিভক্ত করা যায় যেগুলি ঊর্ধগামী অথবা নিম্নগামী বায়ুস্রোতের মাত্রা এবং গতিবিধি দ্বারা নির্ণীত হয়ে থাকে। কালবৈশাখীর পর্যায়গুলি হচ্ছে: ১) কিউমুলাস বা ঘনীপূঞ্জীভবন পর্যায় (cumulus stage), ২) পূর্ণতা পর্যায় (mature stage) এবং ৩) বিচ্ছুরণ পর্যায় (dissipating stage)। একটি কালবৈশাখী পূর্ণতা লাভের ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট পর এর তীব্রতা হ্রাস পেতে থাকে এবং বিচ্ছুরণ পর্যায়ে প্রবেশ করে। অতি দ্রুত হারে তাপমাত্রা হ্রাস, মেঘে প্রচুর জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি এবং বায়ুর পুঞ্জীভূত ঊর্ধ্বচলনের দরুণ কালবৈশাখীর সঙ্গে শিলাপাত একটি সাধারণ ঘটনা।
সাধারণত গ্রীষ্মকালে অতিরিক্ত গরমের সময় শিলাবৃষ্টি হয়। আকাশে যখন মেঘের পরিমাণ অনেক বেশি হয় বা মেঘ অনেক বেশি ভারি হয় ওঠে, তখন বৃষ্টির সময় আকাশ থেকে বরফের টুকরা বা মেঘের কণা পড়ে থাকে; একেই শিলাবৃষ্টি বলা হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালে আকাশের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং ওই সময় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দখিনা বাতাস আসতে থাকে। এইসময় বাংলাদেশের চেয়ে তাপমাত্রা বেশি থাকায় ভারতের বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে ‘হিট লো’ (তাপীয় লঘুচাপ) তৈরি হয়। গরম বাতাস হিসেবে ‘হিট লো’ ধীরে ধীরে বাংলাদেশের স্থলভাগের দিকে আসে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বঙ্গোপসাগর থেকে আগত জলীয় বাষ্পে পূর্ণ আর্দ্র বাতাস। এই দুইয়ের সঙ্গে সিলেট থেকে আসা অপেক্ষাকৃত শীতল বাতাসের সংমিশ্রণে তৈরি হয় মেঘমালা। এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়া মেঘমালাকে বজ্রমেঘ বলা হয়। এগুলো যখন ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৭/১৮ কিলোমিটার উপরে উঠে যায়, জ্বলীয় বাষ্প উপরে উঠে আরও ঠাণ্ডা হয়ে যায় এবং ছোট ছোট বরফ কণায় পরিণত হয়।এই ছোট ছোট বরফ কণা আশপাশের আরও বরফখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং বড় শিলাখণ্ডে পরিণত হয়। এই শিলাখণ্ড যখন বেশি ভারি হয়ে যায়, তখন তার ওজনকে আর বায়ুমণ্ডল ধরে রাখতে পারে না। তখন এগুলো শিলাবৃষ্টি আকারে ভূপৃষ্ঠে নেমে আসে। বায়ুমণ্ডলে থাকা শিলাখণ্ডগুলো অবশ্য অনেক বড় আকারে থাকে। মাটিতে ঝরে পড়ার সময় শিলাখণ্ডগুলো একে অন্যের সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে ছোট হয়ে যায় এবং তা ছোট ছোট আকারের শিলা হিসেবে নেমে আসে। সাধারণত গ্রীষ্মকালে শিলাবৃষ্টি হলেও গত কয়েক বছর ধরে ফাগুন-চৈত্র মাসেই শিলাবৃষ্টির প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। কারণ কী? উত্তর জলবায়ু পরিবর্তন।