আজ বিশ্ব খাদ্য দিবস। এই উপলক্ষে বাঙালির খাদ্যাভ্যাস নিয়ে একটি লেখা।
@মোঃ মোশারফ হোসাইন
………………………………………………………………………….
ভেতো বাঙালির ভাত: অভ্যাস কি পরিবর্তনের দরকার আছে?
“পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খাবার গুলোর একটা হলো ভাত। এই ভাত খেয়ে বাঙালির মেধা-মননের কতটুকু বিকাশ ঘটেছ তা গবেষণা করার প্রয়োজন আছে। ভাত হয় চাল থেকে আর চাল তৈরি করা হয় ধান থেকে। প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে বাংলাদেশে গড়ে তিন হাজার লিটারের (3000 L/kg) বেশি পানি ব্যবহার করি, অনেকের কাছে তথ্যেটা বিশ্বাসযোগ্য না হলেও গবেষণা এটাই বলে। এই দেশে পানির দামে পানি পাওয়া যায় বলেই এটা সম্ভব।(M. Hossain, 2016)”
কিছু দিন আগে আমার এমন একটা Facebook Status ছিল। এরপর বেশ কয়েকজন আমাকে আস্ক করে তাহলে কি আমরা ভাত খাবনা? আরে কি বলে এইসব, বাঙালির হাজার বছরের অভ্যাস এটা কি করে পরিবর্তন সম্ভব? আমি ভেতো বাঙালিদের একজন, আর যাই হোক ভাত তো চাই। সকাল, বিকেল, রাত, ভাতেই যেনো আমার তৃপ্তি।আমার পরিচিত কেউ কেউ ভাত খেতে এত ভালোবাসেন যে পারলে তিন বেলার অধিকও ভাত খান। ভাত যেহেতু পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খাবার গুলোর একটা তাই আমাদের উচিত ধান উৎপাদনে কম পানি বাবহার করা, Alternate Wetting and Drying (AWD) System Adopt করা (এ নিয়ে আরেকদিন বলব)। ভাত বাংলাদেশের ও ভারতের অধিকাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য। চাল কে সিদ্ধ করে তৈরি করা হয় ভাত। বাংলাদেশের চাল থেকে যে ভাত হয় তা মোটামুটি ভাবে ঝরঝরে। কিন্তু চীন, জাপান এবং কোরিয়ার চাল এর ভাত বেশ আঠালো।ভাত রান্নার সময় চাল ভালো করে ধুয়ে পর্যাপ্ত পানি দিয়ে চুলায় সিদ্ধ করতে দেওয়া হয়। সব চাল সিদ্ধ হলে নামিয়ে নেওয়া হয়। ভাতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একটি ভাত টিপেই বোঝা যায় বাকিগুলো সিদ্ধ হয়েছে কিনা।এ নিয়ে অনেক প্রবাদ প্রবচন চালু আছে সমাজে।চাল প্রধানত দুই প্রকার যথা- সিদ্ধ চাল ও আতপ চাল। সিদ্ধ চাল রান্না করার পরে মাড় গালা হয় কিন্তু আতপ চালের ক্ষেত্রে মাড় বা ফ্যান ফেলা হয় না।
প্রাচীন এই বঙ্গের অধিবাসীরা একটি কৃষিভিত্তিক সমাজ সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল। স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান বাংলাদেশের এই আদি সমাজব্যবস্থা সেই সংস্কৃতির অংশ। ভৌগোলিক অবস্থান এবং নাতিশিতোষ্ণ জলবায়ুর কারণে প্রচুর জলরাশি বেষ্ঠিত সবুজে ঘেরা এ দেশে কালের পরিক্রমায় ধান প্রধান কৃষিপণ্য হয়ে ওঠে।তাই বাঙালির বা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভাতনির্ভর খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে। ভাতের উৎস ধান এক সময় বুনো কৃষিপণ্য হিসেবেই ফলতো প্রাচীনকাল থেকে। ফলে এর চাষের সুনির্দিষ্ট সময় সম্পর্কে কোনো ঐতিহাসিক তথ্য নেই। ধান গবেষকদের মতে, পরিকল্পিত ধানচাষের শুরু আজ থেকে দশহাজার বছর আগে চীন ও জাপানে। পর্যায়ক্রমে উত্তর কোরিয়া থেকে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া হয়ে ভারতবর্ষে ধানচাষের শুরু। বিবর্তনের ধারায় বাংলাদেশের মানুষের প্রধান শস্য এখন ধান।
প্রাচীন বাংলায় নানা কৃষিপণ্যের সাথে ধানের উৎপাদন হলেও পরিকল্পিত ধানচাষের ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। গবেষকদের মতে, ব্রিটিশ শাসনামলের গোড়ার দিকে শিল্পকর্ম ও সুতিবস্ত্রের উৎপাদন ব্যাহত হলে 1921 সালের পর মোট জনসংখ্যার প্রায় 78 ভাগ মানুষ ঝুঁকে পড়ে ধানচাষে বা ধান উৎপাদনে। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার অসংখ্য শাখানদী এবং নিচু উর্বর ভূমিতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে ধানচাষ। কখনো কখনো কোনো অঞ্চলের জমিতে বছরে একবার ধানচাষ করা সম্ভব হতো। আবার কোনো অঞ্চলের জমিতে বছরে দুইবার ধানচাষ করা যেতো। তবে, আধুনিকায়নের ছোঁয়া লেগে দেশের ধানি জমিগুলোতে বছরে এখন তিন মৌসুমে ধানচাষ হয়। এই দেশে চাষে রীতি মতো বিপ্লবের ছোঁয়ালাগে আশির দশকের শুরু দিকে। সেই থেকে ধারাবাহিক সফলতা ক্রমেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূণর্ করেছে দেশকে। তিন মৌসুমের তিন ধানের মধ্যে আউশ ও আমন মিলে বছরে যা উৎপাদন হয় বোরোধান একাই বছরে তার প্রায় সমপরিমান উৎপাদিত হয়। ফলে তিন ফসলী ধানের মধ্যে বিশেষ গুরুত্ব পায় বোরো।
ইন্টারনেটের এ যুগে বাঙালির খাবারের অভ্যাস অনেকটা বদলে গিয়েছে।তাই অনেকে এখন ভাত খেতে ভালোবাসেন না। তারা রুটিকে প্রধান খাবার হিসেবে বেছে নিচ্ছেন।আবার অনেকের ধারণা ভাতে উপকারী তেমন কোনো উপাদান নেই। কিন্তু এ ধারণা মোটেও ঠিক নয়। কেননা ভাতে রয়েছে নানা স্বাস্থ্যগুণ। দেখা যাক কি কি স্বাস্থ্যগুণ রয়েছে-
১. লো-ক্যালরি ফুড: একটা ধারণা বেশ ভালোভাবেই সমাজে প্রচলিত আছে যে, ভাত খেলে মোটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু অন্য আর সব খাবারের মতোই ভাত পরিমিত পরিমাণে খেলে মোটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। 100 গ্রাম ভাতে রয়েছে প্রায় 100 ক্যালরি। ফ্যাটের পরিমাণও খুব কম, ভাত্র 0.4 গ্রাম। আটার রুটির প্রায় সমান ক্যালরি। ময়দা, পরোটা বা তেলে ভাজা পুরির তুলনায় ভাত খাওয়া উপকারী। দিনে দু বার ভাত খেতেই পারেন, তবে উচ্চতা ও ওজন অনুযায়ী ভাতের পরিমাণ নির্দিষ্ট রাখতে হবে। অনেকে এ কথা বিশ্বাস করবেনা, তাদের জন্য একটা Research Finding নিচে দেওয়া হল। পড়ে নিন-
30 গ্রাম ভাতের ক্ষেত্রে কার্বোহাইড্রেট থাকে 23 গ্রাম। আবার 30 গ্রাম আটার ক্ষেত্রে কার্বোহাইড্রেট থাকে 22 গ্রাম। ভাতে প্রোটিন থাকে 2 গ্রাম আর আটা বা রুটির ক্ষেত্রে প্রোটিন থাকে ৩ গ্রাম। ভাতে ফ্যাট থাকে 0.1 গ্রাম এবং আটা বা রুটিতে ফ্যাট থাকে 0.5 গ্রাম। ভাতে ফাইবার থাকে 0.1 গ্রাম এবং আটা বা রুটিতে থাকে 0.7 গ্রাম। ভাতে আয়রন থাকে 0.2 মিলিগ্রাম এবং রুটিতে থাকে 1.5 মিলিগ্রাম। একই পরিমাণ ভাতে ক্যালসিয়াম থাকে 3 মিলিগ্রাম এবং আটাতে বা রুটিতে থাকে 12 মিলিগ্রাম। ভাতে এনার্জি থাকে 100 ক্যালোরি ও আটাতে থাকে 100 ক্যালোরি।ভাত এবং রুটি দুটিতেই আছে প্রচুর ফলেট যা নতুন কোষ গঠনে সাহায্য করে এবং রক্তে অক্সিজেন সরবরাহ করে। শিশুর জন্মগত ত্রুটি ঠেকাতেও কার্যকর। সেই কারণে গর্ভবতী মায়েদের রুটির থেকে ভাত বেশি খাওয়া ভালো। রুটি ও ভাতে আয়রনের পরিমাণ সমান হলেও ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম ও পটাসিয়ামের পরিমাণ রুটির তুলনায় ভাতে কম। সব মিলিয়ে ভাত, রুটি দুটিতেই রয়েছে উপকার। আর চিকিৎসকরা মনে করেন, ভাত ও রুটি মিশিয়েই খাওয়া উচিত। দুটি খাবারই শরীরের কোনও না কোনও প্রয়োজন পূরণ করে।
২. শক্তি ও ভিটামিনের আধার: ভাতে প্রচুর পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট থাকে। সেই কার্বোহাইড্রেট শরীরে শক্তি জোগায়। ভাতে থাকে অ্যামাইনো অ্যাসিড। যা পেশিবৃদ্ধিতে সাহায্য করে। গ্যাসের সমস্যার মোকাবিলাতেও ভাতের জুড়ি মেলা ভার। রক্তচাপ ও কিডনির সমস্যায় যারা ভুগছেন, তাদের জন্যও উপকারি সাদা ভাত। ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে এটি সহায়ক। ভাতে উপস্থিত শর্করা পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। ভাতে থাকে B1। যা হার্টের পাশাপাশি স্নায়ুকেও ভালো রাখে। ভাতে যথেষ্ট পরিমাণে নিয়াসিন, ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম, ফাইবার, আয়রন, থিয়ামিন ও রাইবোফ্লাভিন রয়েছে।
৩. সহজে হজম হয়: কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার হওয়ায় ভাত সহজে হজম হয়। হজমপ্রক্রিয়ার জন্য ভাত খুব উপকারী। বিশেষ করে ডায়রিয়া হলে জাউভাত খুব ভালো কাজে দেয়।
৪. বাওয়েল মুভমেন্টের জন্য উপকারী: ভাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে স্টার্চ। স্টার্চ স্বাভাবিক বাওয়েল মুভমেন্টের জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়া নিঃসরণে সহায়তা করে। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকলে বা বদহজমের সমস্যা হলে ভাত খাওয়াটাই ভালো।
৫. হাইপারটেনশনে নিরাপদ:ভাতে কোলেস্টেরল ও সোডিয়াম নেই। হাইপারটেনশনের সমস্যা যাদের রয়েছে তারা ডায়েটে ভাত রাখার চেষ্টা করুন।
৬. গ্লুটেন মুক্ত: গম, বার্লি, ওটসে এক ধরনের বিশেষ প্রোটিন রয়েছে ‘গ্লুটেন’, যা অনেকেই হজম করতে পারে না। ভাতে গ্লুটেন না থাকায় যারা গ্লুটেন-ফ্রি ডায়েট মেনে চলেন তাদের জন্য ভাত উপযোগী। এ কারণেই পেটের সমস্যার সময় জাউভাত খেলে উপকার পাওয়া যায়।
শেষের দিকে আরেকটা Research Finding দিয়ে আজকের আয়োজন শেষ করি। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার কলেজ অব কেমিক্যাল সায়েন্সের একদল গবেষকেরা আমাদের মতো ভেতো বাঙালির জন্য সুখবর বয়ে এনেছে তাঁদের দাবি, এই পদ্ধতি অবলম্বন করে ভাত রাঁধলে ভুঁড়ি তো হবেই না, বরং ভাতে উপস্থিত ক্যালোরি প্রায় 50-60 শতাংশ কমিয়ে ফেলা যায়। আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি-র জাতীয় সমাবর্তনে গবেষণার প্রধান সুধের জেমস জানান, শর্করার রকমফেরের উপর ভিত্তি করেই এই গবেষণা করা হয়েছে। বিশ্বের প্রায় 38 রকম চালের উপর পরীক্ষা চালিয়েছে সুধেরের দল। তাঁদের মতে, এমনিতেই সরল শর্করা হজম করতে যত না সময় লাগে, তার চেয়ে জটিল শর্করা হজমে সময় লাগে অনেক বেশি। আর এতেই শরীরে জমে যায় গ্লাইকোজেন। কতখানি গ্লাইকোজেন শরীরে জমছে, তার উপরই নির্ভর করে শরীরে মেদ জমার সম্ভাবনা। গ্লাইকোজেন কমাতে বেশি এনার্জির প্রয়োজন। তাই ভাতের জটিল শর্করাকে সরলে পরিণত করলেই তা কমায় ওবেসিটির ভয়। নারকেল তেল শরীরে গ্লাইকেজেনকে গলাতে সাহায্য করে। তাই চাল ফোটানোর আগে পানিতে নারকেল তেল ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন গবেষকরা। শুধু তা-ই নয়, ভাত রান্নার পর তাকে বারো ঘণ্টা ফ্রিজে রেখে খাওয়ার আগে গরম করে খেতে বলছেন তাঁরা। এতে শর্করার হাইড্রোজেন বন্ড ভেঙে নতুন আকার নেয়। ফলে শরীরে দ্রবীভূত শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়। মেদ জমে না। আমেরিকার সেই সমাবর্তনে হাজির অন্য গবেষকরাও এতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। নানা দেশে ভাত রান্নার পদ্ধতি ও তাদের খাদ্যাভ্যাসকে মাথায় রেখে এই পরীক্ষা পদ্ধতির আরও প্রয়োগ চেয়েছেন। তাঁদের আশা, এই নিয়মে ভর করে ভাত রান্না করলেই কমবে মেদ।