ইসরায়েল ও ফিলিস্থানের দ্বন্দ্বের ইতিহাস
মোহাম্মদ খলিলুর রহমান খলিল পরদেশী ঃ গাজা ও ইসরায়েলের মধ্যে সীমান্তবর্তী একটি জায়গার নাম হল কিনাল, কিনালে একজন দেবতা ছিল তার নাম হলো সালেম,সালেম মানে হল সূর্যাস্তের দেবতা। সালেম মূলত একটি পাথর, এই পাথরটি ছিল উচু পাহাড়ের মাঝখানে। এই পাহাড়ের আশেপাশে পানির উৎস পাওয়া যায়, ধীরে ধীরে স্থাপিত হয় জনবসতি, এটিই পরবর্তীতে জেরুজালেম শহর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। জেরুজালেমের তিনটি জাতি বসবাস করতো, ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম। এই জেরুজালেম শহরটি তিন ধর্মের জন্যই পবিত্র স্থান। আজকের দিনে মুসলিম সম্প্রদায় যে মক্কা কে কেবলা মনে করে আদিকালে মূলত কেবলা ছিল আল-আকসা, আর সেই আল আকসা শহর থেকেই নবী করীম সাঃ এর মেরাজে গিয়েছিলেন। জেরুজালেম থেকে ৮.৮ কিলোমিটার দূরে যীশু খ্রিস্টের জন্ম হয়েছিল এজন্য খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষজন ও এই শহরকে পবিত্র হিসেবে মানে। এজন্য এই জেরুজালেম শহরটি ছিল সকল ধর্মের জন্য পবিত্র স্থান। হযরত আদম আদম আঃ এর তিন পুত্র ছিল হাবিল, কাবিল ও শীষ। হাবিল কাবিলকে হত্যা করে। শিষের ঘরে নুহ আঃ এর জন্ম হয় ১০০০ বছর পর দশম পুরুষ হিসেবে। নুহ আঃ ছিল চার ছেলে সাম, হাম, এয়াফিসও ইয়াস।সাম থেকে আরব ও ইহুদি বংশের সৃষ্টি হয়। হাম থেকে মিশরীয় সৃষ্টি হয়। ইয়াফিস থেকে ইন্দো ইউরোপীয়র সৃষ্টি হয় অর্থাৎ ইউরোপ, ইরান ও ভারতের সৃষ্টি হয় আর ইয়াসমহা প্লাবনে মৃত্যুবরণ করেন। আরব ও ইহুদী থেকেই ইব্রাহিম আঃএর আগমন ঘটে ইব্রাহিম আঃ এর দুই স্ত্রী ছিল সারাহ ও হাজেরা।আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহিম আঃ সারাহকে জেরুজালেমে আর হাজেরা কে মক্কায় রেখে আসেন। সারাহর ঘরে জন্ম ইসহাক আঃএর আর ইসহাক আঃ ঘরে জন্ম হয় ইয়াকুব আঃ। আর ইয়াকুব আঃএর ছিল ১২ ছেলে। ১২ জনের মধ্যে একজন হল ইয়াহুদা আরে আর এই ইয়াহুদা থেকে যে জাতির উৎপত্তি সেটি হল ইহুদী।
অপর দিকে হাজেরা থেকে ইসমাইল আঃজন্ম হয়। তারই ধারাবাহিকতায় হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম এর আগমন ঘটে।
আর এই ইহুদিদের আদি নিবাস হলো কুনাল তারা মনে করে এটি সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ভূমি।
নেবুচাদ নেজার যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৫০০ বছর আগে ইহুদিদের কুনাল থেকে বিতাড়িত করেন। ইহুদিরা বিতাড়িত হয়ে জার্মানি ও রাশিয়ায় অবস্থান করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের দ্বন্দ্ব হই।
বিশেষ করে হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৭ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করে। তখন ইহুদীরা চিন্তা করে তাদের আদি ভূমি কোনালে ফিরে যাবে, আর এই দাবিটা করেছিল প্রথমে থিওডোর হার্জেল ১৮৯৬ সালে। ইহুদি রাষ্ট্র চাই এই দাবীতে ১৮৯৭ সালে জায়ানিস্ট আন্দোলন নামে সংগঠিত হয় ইহুদীরা।এই আন্দোলনকে বাস্তবায়ন করতে জায়ানিস্ট সংঘ গঠিত হই। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল আলাদা আবাসভূমি আদি নিবাস কোনালে ফিরে যাওয়া। জায়নিস্ট এ আন্দোলন চালানোর সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সালে বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, এক ভাগে ছিল যুক্তরাজ্য আরেক ভাগে ছিল তুরস্ক ও জার্মানি। যুক্তরাজ্য মূলত জার্মানি থেকে অস্ত্র সরবরাহ করতো জার্মানি যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে যুক্তরাজ্যকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেয় এতে করে যুক্তরাজ্য সংকটে পড়ে তখন যুক্তরাজ্যের পাশে এসে দাঁড়াই ইহুদিদের এক বিজ্ঞানী চাইম ওয়াইজম্যান
তিনি তাদেরকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করেন তখন যুক্তরাজ্য ১৯১৭সালে তাকে সংবর্ধনা দেই এবং বলে তুমি কি চাও উপহার হিসেবে? চাইম বলেন ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এই চাইম ইসরায়লের প্রথম প্রেসিডেন্ট। চাইম ওয়াইজমেন্ট ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বর ব্রিটেনের বেলপুর কে একটি চিঠি লিখেন তখন থেকেই ফিলিস্তিনে গিয়ে ইহুদিরা বসতি স্থাপন শুরু করেন।
১৯১৪ সালে ইহুদি ছিল তিন হাজার, ১৯১৮ সালে বিশ হাজার, ১৯২৩ সালে ৩৫ হাজার, ১৯৩১ সালে এক লক্ষ আশি হাজার, ১৯৪৬ সালে ৬ লক্ষ, ২০২৩ সালে ৯৫ লক্ষ ইহুদীর সংখ্যা হয়।ইহুদীরা তখন একটি গুপ্ত বাহিনী তৈরি করেন গুপ্ত বাহিনীর নাম হল হাগানাহ। তাদের লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনি কে হত্যা করা, বোমা মারা ভূমি দখল করা।জাতিসংঘ ১৯৪৭ সালের ফিলিস্তিন এবং ইহুদিদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ বসবাসের জন্য ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা চাই, সেই অনুসারে ইহুদিদের ভাগে পরে ৫৫% ভূমি ফিলিস্তিনের ভাগপ পড়ে ৪৫ পার্সেন্ট ভূমি।মূলত তখন ছিল ইহুদিদের শুধুমাত্র ৬ লক্ষ লোক আর ফিলিস্তিনিতে ছিল ১৭ লক্ষ লোক। জাতিসংঘে বিল পাস করানোর ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে ইজরাইলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষনা করেন, ঘোষণার তিন ঘণ্টা পর আমেরিকা ইসরাইলকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল ফিলিস্তিনিকে হামলা চালিয়ে সাত কক্ষ লোক হত্যা করে, ১৯৫৬ সালে মিশরে সুয়েজ খাল সংকট দেখা দিলে মিশরের সাথে ইসরাইল এবং বৃটেনের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এতে করে ইসরাইল ব্রিটেনের সাথে মিলপ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল জর্ডান নদীর গতিপথ পরিবর্তন করতে চাই তখন সিরিয়া ও মিশর বাধা প্রদান করেন।এতে করে যুদ্ধ বাধে ইসরাইল এই যুদ্ধে জয়লাভ করে।তখন ইসরাইল নিজেদেরকে আরও শক্তিশালী ভাবতে শুরু করে। তখন তারা গাজা সহ দুইটি শহরে হামলা করে তাদের দখলে নিয়ে যায়। তখন ইজরাইলের আয়তন আরো বড় হয়ে যায়। ১৯৬৯ সালে আল আকসা মসজিদ অগ্নিদগ্ধ হলে ওআইসি গঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে ইসরাইলের এলাকা সিরিয়া ও মিশর হামলা চালাই তখন আমেরিকা কে আরব বিশ্ব তেল অবরোধ করেন। আমেরিকা অর্থনৈতিকভাবে সংকটে পড়ে যায়। আমেরিকার বিখ্যাত পররাষ্ট্র ব্যক্তিত্ব হেনরি কিসিঞ্জার শাটল ডিপ্লোমেসির প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্যাম্প ডেবিট চুক্তি স্বাক্ষরিত হই ১৯৭৮ সালে।যার ফলশ্রুতিতে ইসরাইলকে মিশর স্বীকৃতি দেয় আর এই কাজটি করার পিছনে ভূমিকা রাখে তৎকালীন মিশরের নেতা আনোয়ার সাদাত। আনোয়ার সাদাত এই ভূমিকার কারণে আমেরিকার মাধ্যমে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৮২ সালে।
এই স্বীকৃতি দেয়ার কারণে ওআইসি মিশরকে বহিষ্কার করে।
মূলত গাজার সাথে ৫৮ কিলোমিটার ইসরাইলের সীমানা তারপর ভূমধ্যসাগর হলো ইজরাইলের দখলে এজন্য বহির বিশ্বের সাথে ফিলিস্তিন যোগাযোগ কঠিন হয়ে পড়ে।
এজন্য ফিলিস্তিনকে পৃথিবীর অবরুদ্ধ কারাগার বলে
এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে ১৯৮৭ সালে হামাস গভীর দেশ প্রেমের উদ্দেশ্য নিয়ে ইসরাইলকে উৎখাত ও ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। ইয়াসিন আরাফাত ১৯৯৩ সালের নরওয়ের অসলোতে গিয়ে একটি চুক্তি করলেন যার নাম হল অসলো চুক্তি। যার মাধ্যমে ইসরাইল ফেরত দিবে দখলকৃত ভূমি,আর বিনিময়ে ইজরায়েল স্বীকৃতি পাবে স্বাধীন দেশ হিসেবে।
এই চুক্তির কারণে ইয়াসিন আরাফাত শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাই কিন্তু ইসরাইল স্বীকৃতি পেলে ও জাতিসংঘের মাধ্যমে ইসরাইল ফিলিস্তিনকে তাদের ভূমি ফেরত দেন নাই।
চুক্তিভঙ্গের কারণে হামাস নতুন করে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তখন ফিলিস্তিনিতে দুটি সংগঠনের সৃষ্টি হয়, একটি হল হামাস আরেকটি হল ফাতাহ। হামাস যারা ইসরাইলকে স্বীকার করে না। ফাতাহ হলো উদারপন্থী যারা ইসরাইলকে স্বীকার করে। এজন্য হামাসকে ফিলিস্তানের লোকজন পছন্দ করতে শুরু করে।
২০০৫ সালে ফিলিস্তিনিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচনে হামাসের নেতৃত্বে জয় লাভ করে ফাতাহ পরাজিত হয়। হামাস সর্বপ্রথম গাঁজা নিয়ন্ত্রণে নেন পশ্চিম তীর নিয়ন্ত্রণে নেন ফাতাহ। তখন ফিলিস্তানকে যুদ্ধ করতে হয়েছে ঘরেও বাইরে। তখন হামাস যুদ্ধ করতে হয়েছে ইসরাইলের সাথে, যুদ্ধ করতে হয়েছে নিজের দেশের সংগঠন ফাতাহের সাথে। ফাতাহ ইসরাইল ও আমেরিকার সাথে মিলে হামাসকে ধ্বংস করতে চাই।
হামাস ইসরাইলের নিকট তিনটি দাবি করেন, অবরোধ তুলে নিতে হবে, বন্দী মুক্তি দিতে হবে, ভূমি ফেরত দিতে হবে।
তারই ধারাবাহিকতায় হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ দেইফ ৩০০ মাইলের একটি টানের নির্মাণ করেন, ইসরাইল সীমান্তে পাঠানো হয় বোল্ট ড্রোজার,টানেল দিয়ে এবং ভোল্ট ডোজার দিয়ে ইসরাইল কে আক্রমণ করেন। ইজরাইল পাল্টা আক্রমণ করে ফিলিস্তিনের আলবিদা হসপিটাল সহ হাজার হাজার লোক মারেন।
প্রায় ১০০ বছর ধরে এই যুদ্ধ চলে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর ইসরাইলের যুদ্ধ শুরু হয় যা এখন পর্যন্ত চলমান। জাতিসংঘের মাধ্যমে বারবার যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা আসলেও ইসরাইল এই চুক্তি ভঙ্গ করে হাজার হাজার ফিলিস্তিনের মুসলিমকে হত্যা করে চলছে, এই রক্তের হোলি খেলার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের বেশ কয়েকটি শহর মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে, শ্মশানের মত যে দিকে তাকাবে শুধু অগ্নিকাণ্ড, আগুনের লিলিহান শিখা মৃত মানুষের গন্ধ, দিক বেদিক ছুটে চলছে স্বজন হারা মাসুম বাচ্চারা।
রহস্যজনক কারণে বিশ্ব বিবেক চুপ, বিশ্ব মানবতার ফিলিস্তিনের শিশু বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত, হসপিটালের রোগী, মসজিদের ইমাম, এমন কোন ব্যক্তি বাদ যাইনি ইসরাইলের হামলা থেকে। সারা বিশ্বে ইসরাইলের এই হামলার বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা চলছে। সারা বিশ্বে তীব্র নিন্দার ঝড় বয়ছে। জাতিসংঘ অচিরেই এই দখলদার কসাই ইজরাইলের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিবেন বলে বিশ্ববাসী মনে করেন। এই পর্যন্ত ৬২ হাজার লোক ফিলিস্তিনের শহীদ হয়েছে।