নিচে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর (Ground Water Deplation): এক নতুন বিপদের হাতছানি।
মোঃ মোশারফ হোসাইন
“নদী শুকায়, নলকূপও রিক্ত, নেমে যায় জলস্তর,
ভূগর্ভ কাঁদে তৃষ্ণায় কাতর, কোথায় তার নিঝর?
নদী-খাল আজ তৃষ্ণার্ত, কূপের তলায় ফাটল,
ভূগর্ভস্থ জল হারিয়ে যায়, নিঃশব্দে বাজে শঙ্কার নতুন বিপদ।”
উপরে বর্ণিত কাব্যচরণগুলোর মতোই ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের অবনমন হওয়ায় কথা ধ্বনিত হয় আমার বর্তমান কর্মস্থল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার অধিকাংশ মানুষের মুখে মুখে। তাদের নলকূপগুলোতে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পানির জন্য হাহাকার করছে, নলকূপে পানির ঝমঝম শব্দও আর আগের মতো শুনতে পাওয়া যায় না। শহরগুলোতে পানির সংকট বাড়ছে, পিপাসার তৃষ্ণা মেটাতে মানুষকে লম্বা লাইন ধরে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। মূলত মাত্রাতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ফলে ভূপৃষ্ঠের পানি (Surface Water) নিচে যেতে পারে না, ফলে পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, পূর্বে ২০/৩০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া গেলেও শুষ্ক মৌসুমে এই পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যায়। আজকের আলোচনায় এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো, তার আগে জেনে নেই, পৃথিবীতে পানির পরিমাণ কত এবং কোথায় কিভাবে এই পানি রয়েছে।
পৃথিবীতে মোট পানির পরিমাণ প্রায় ১.৩৮ বিলিয়ন ঘন কিলোমিটার (১৩৮ কোটি ঘন কিলোমিটার) বা ৩২৬ মিলিয়ন ঘন মাইল। এর মধ্যে প্রায় ৯৭.৫% লবণাক্ত পানি (সমুদ্র ও মহাসাগরে) এবং মাত্র ২.৫% মিঠা পানি, যা হিমবাহ, ভূগর্ভস্থ জলাধার, হ্রদ, নদী ও বায়ুমণ্ডলে সঞ্চিত থাকে। উল্লেখ্য পৃথিবী পৃষ্ঠের ৭১% পানি দ্বারা বেষ্টিত, যার ফলে দূর থেকে পৃথিবীকে নীল দেখায়। এবং এই জন্য পৃথিবীকে বলা হয় ব্লু প্ল্যানেট (Blue Planet) বা নীলগ্রহ। খালি চোখে পৃথিবী পৃষ্ঠে যে পানি দেখা যায়, এর বেশিরভাগই ব্যবহারের অযোগ্য। পৃথিবীতে বিদ্যমান মোট পানির অবস্থান শতকরা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সমুদ্রে রয়েছে ৯৭.৫% পানি, মেরুর বরফ ও বায়ুমণ্ডলে রয়েছে ১.৮৫% পানি এবং ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ ০.৬১% । পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পানি থাকলেও, মানুষ তার ব্যবহারের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। হিসেব করে দেখা গেছে পৃথিবীতে থাকা মোট পানির ৯৯.৭% পানি মানুষ সরাসরি ব্যবহার করতে পারে না; বিশেষ করে সমুদ্রের পানি, বায়োমন্ডলে থাকা পানি, মেরুতে জমে থাকা পানি ইত্যাদি। মানুষের ব্যবহার উপযোগী পানি অর্থাৎ ফ্রেশ ওয়াটার (Fresh Water) এর বড় একটি অংশ রয়েছে মাটির নিচে, যাকে বলা হয় গ্রাউন্ড ওয়াটার (Ground Water) বা ভূগর্ভস্থ পানি। একজন Hydrologist এর ভাষায়- “ভূগর্ভস্থ পানি হল ভূ-পৃষ্ঠের নিচে মাটির ছিদ্র ও শিলার ফাটলে সঞ্চিত পানি, যা সাধারণত অ্যাকুইফার (Aquifer) বা জলাধারে সংরক্ষিত থাকে। এর একটা বিস্তৃতি ডেফিনেশন হলো- “Groundwater is the water that exists beneath the Earth’s surface in the pore spaces of soil, sand, and rock, and in the fractures of geological formations. It is stored in underground reservoirs called aquifers and is a major source of fresh water for drinking, irrigation, and industrial use. Groundwater moves slowly through permeable layers of rock and soil and can be replenished through precipitation and surface water infiltration.”
এখন প্রশ্ন হলো ভূগর্ভস্থ পানি, অর্থাৎ মাটির নিচে কিভাবে পানি জমা থাকে। ভূপৃষ্ঠের উপরে থাকা নদীর পানি, জলাশয়ের পানি কিংবা বৃষ্টির পানি এরা মাটি চুইয়ে ভূপৃষ্ঠের নিচের দিকে যায় (Ground Water Infiltration)। অনেকটা বালুর মধ্যে পানি দিলে যেমন পানির নিচে চলে যায়, ঠিক তেমন। তবে এখানে একটি বিষয় রয়েছে। পানি যদি মাটি চুইয়ে শুধু নিচেই যেতে থাকে, তবে পানি অনেক গভীরে চলে যাবে এবং পানি এতটাই নিচে চলে যাবে যে সেখান থেকে পানি তোলা সম্ভব হবে না। ভূপৃষ্ঠের নিচের মাটিতে বিভিন্ন ধরনের শিলা স্তর রয়েছে। এদের মধ্যে একটি ধরনের শিলা স্তর হচ্ছে “অ্যাকুইফার (Aquifer)”। এই অ্যাকুইফার নুড়ি, বালি, পলি ইত্যাদি দিয়ে তৈরি। অ্যাকুইফারের বৈশিষ্ট্য হলো, এই শিলাস্তরকে পানি ভেদ করতে পারে না। অর্থাৎ, একই ফারে থাকা নুড়ি-বালির ফাঁকে ফাঁকে পানি জমা থাকে এবং এই পানিকেই বলা হয় ভূগর্ভস্থ পানি। একই ফারের সাইজ ছোট থেকে বড় হতে পারে। এটি ভূপৃষ্ঠের নিচে বিভিন্ন গভীরতায় থাকতে পারে এবং বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতে পারে।
আমেরিকাতে ছোট-বড় মিলিয়ে ৬৮টির মতো অ্যাকুইফার রয়েছে। নিউজিল্যান্ডে রয়েছে ২০০টির মতো। গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে মূলত তিনটি প্রধান অ্যাকুইফার (Aquifer) রয়েছে, যা ভূগর্ভস্থ পানির প্রধান স্তর হিসেবে বিবেচিত যথা-
১. উপরি অ্যাকুইফার (Shallow Aquifer): এটি ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থিত এবং সাধারণত ১০-৭০ মিটার গভীরতায় পাওয়া যায়।
২. মধ্যম স্তরের অ্যাকুইফার (Main Aquifer or Intermediate Aquifer): এটি প্রধান ভূগর্ভস্থ জলাধার হিসেবে বিবেচিত হয় এবং প্রায় ৭০-১৫০ মিটার গভীরতায় অবস্থান করে।
৩. গভীর অ্যাকুইফার (Deep Aquifer): এটি ১৫০ মিটারের নিচে অবস্থিত এবং অনেক ক্ষেত্রে ৩০০ মিটারের বেশি গভীরতায় পাওয়া যায়। এই তিন স্তরের অ্যাকুইফারই কৃষি, পানি সরবরাহ ও শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূগর্ভস্থ পানির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
লেখাটা পড়তে পড়তে এই পর্যায়ে এসে আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, অ্যাকুইফারে বালি এবং পলির ফাঁকে থাকা পানি কিভাবে উপরে আসে। মনেকরুন, ভূগর্ভের কোনো একটি স্থানে একটি অ্যাকুইফার রয়েছে এবং অ্যাকুইফারে থাকা পানির লেভেল, অর্থাৎ ওয়াটার টেবিল এই পর্যন্ত। এখানে খেয়াল করুন, পানি কিন্তু বিশাল কোনো ফাঁকা স্থানে অবস্থান করছে না, বরং বালির ফাঁকে ফাঁকে অবস্থান করছে। এখন একটি পাইপ অ্যাকুইফারের গভীরতা পর্যন্ত স্থাপন করা যাক। এই পাইপের ভেতরে দেখুন, পানি জমা রয়েছে এবং সেই পানি ভূগর্ভস্থ পানির লেভেল পর্যন্ত রয়েছে। অর্থাৎ, বালির ফাঁকে ফাঁকে থাকা পানি পাইপের মধ্যে এসে জমা হয়েছে। এখন পাইপের মধ্যে জমা থাকা এই পানি একটি নলকূপের মাধ্যমে বের করে নিয়ে আসা যাক। এখানে খেয়াল করুন, পানি বের করে নিয়ে আসার ফলে যে পরিমাণ পানি কমে যাচ্ছে, তার সাথে সাথেই তা পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কারণ, পাইপের ভেতরে থাকা পানি বের করে ফেলার কারণে পাইপের ভেতরে নিম্নচাপ তৈরি হয়। অন্যদিকে, পাইপের বাইরে উচ্চচাপ বিরাজ করে। ফলে পাইপের নিচ দিয়ে পানি এসে চাপের অসমতাকে ব্যালেন্স করে। এভাবেই আমরা ভূগর্ভস্থ পানি পেয়ে থাকি।
আমরা জানলাম কিভাবে অ্যাকুইফার থেকে আমরা পানি পেয়ে থাকি। অ্যাকুইফার থেকে এভাবে অনবরত পানি উঠানোর ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। তবে আমরা যদি পানি তোলার সাথে সাথে সমপরিমাণ সারফেস ওয়াটার এখানে রিফিল করি, তবে পানির লেভেল নিচে নামবে না। যেমন বৃষ্টির পানি যদি নিচে নামার সুযোগ করে দেই। এই শুষ্ক মৌসুমে প্রায় সময় একটি কথা আমরা শুনে থাকি, এবং সেটি হচ্ছে “পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।” এমনটা ঘটে মূলত, যে পরিমাণ পানি আমরা ভূগর্ভ থেকে তুলে আনছি, সেই পরিমাণ পানি রিফিল হচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে, আমরা ভূপৃষ্ঠকে কংক্রিট দিয়ে ঢেকে দিচ্ছি। ফলে বৃষ্টির পানি বা অন্যান্য উৎসের পানি মাটি চুইয়ে নিচে যেতে পারছে না। যার কারণে আমরা পানি তুলে আনার ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে এবং তার রিফিল হচ্ছে না। দেশের অনেক স্থানে পূর্বে যেখানে মাত্র ১০ থেকে ২০ ফুট গভীরতার কুয়া খুললেই গ্রাউন্ড ওয়াটার পাওয়া যেত। বর্তমানে সেটা সম্ভব নয়। কারণ, অ্যাকুইফারে থাকা পানির ওয়াটার লেভেল নিচে নেমে গেছে। কেন নিচে নেমে যাচ্ছে অর্থাৎ Ground Water Deplation হচ্ছে, মোটা দাগে কারণ সমূহ হলো-
১. অতিরিক্ত পানি উত্তোলন (কৃষি, শিল্প ও গৃহস্থালির জন্য)।
২. অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ন্ত্রিত নলকূপ স্থাপন।
৩. বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তন।
৪. নদী, খাল ও জলাভূমি শুকিয়ে যাওয়া।
৫. শহরায়ন ও কংক্রিটের রাস্তা, যা ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জে বাধা সৃষ্টি করে।
৬. বন উজাড় ও ভূমির স্বাভাবিক কাঠামোর পরিবর্তন।
৭. শিল্প ও কৃষিতে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার
৮. পর্যাপ্ত পানি সংরক্ষণের অভাব ও ভূগর্ভস্থ জল পুনর্ভরণ ব্যবস্থার অভাব।
এতটুকু লেখা পড়ে যারা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছেন তাদের জন্য একটা মজার তথ্য দেই। আপনারা জানেন কী, “বাংলাদেশে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে গড়ে তিন (৩) হাজার লিটারের চেয়ে বেশি পানি ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে বোরো ধান উৎপাদনে সর্বাধিক পানি লাগে।” এই গবেষণাটি আমার নিজের হাতে করার সুযোগ হয়েছিল, আমি যখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (BUET) থেকে পানি সম্পদ উন্নয়নে (WRD) মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করি। আমার স্টাডি এরিয়া ছিলো নরসিংদী জেলার সদর ও রায়পুরা উপজেলা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর ও বাঞ্ছারামপুর উপজেলা। আমাদের কৃষকরা বিভিন্ন সেচ কার্যক্রমের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ ও ভূপরিস্থ পানি যথাযথভাবে ও পরিকল্পিত উপায়ে ব্যবহার না করায় পানি ব্যবহারে দক্ষতা কমছে দিন দিন। এজন্য পানি ব্যবহারে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন পানি বিশেষজ্ঞরা। পাঁচ দশক আগেও বাংলাদেশে পানির প্রধান উৎস ছিল খাল, বিল, নদী ও পুকুর। সময়ের আবর্তে শুকিয়ে গেছে অনেক নদ-নদী। ভরাট হয়ে গেছে জলাশয়গুলো। এর ফলে চাপ পড়েছে ভূগর্ভের পানির ওপর। বাংলাদেশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, “পানির স্তর বছরে দুই থেকে ৩ মিটার নিচে নামছে।” ওয়াটার এইড বাংলাদেশের গবেষণায় ৩ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ সুপেয় পানির উৎস থেকে বঞ্চিত বলে জানানো হয়েছে। তাই ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পানি ব্যবহারে এখনই সতর্ক না হলে ভবিষ্যত প্রজন্মকে এর জন্য খেসারত দিতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি করেন তাঁরা। দেশের উজানে পদ্মা ও তিস্তাসহ অভিন্ন ৫৪টি নদীতে ভারত কর্তৃক বাঁধ নির্মাণসহ নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির চাহিদা বেড়েছে। গত চার দশকে দেশে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়েছে প্রায় শতভাগ। খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচ, এমনকি দৈনন্দিন কাজেও ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে মানুষ। এখন সুপেয় ও চাষাবাদের জন্য চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পানিই মেটাতে হচ্ছে ভূ-গর্ভ থেকে। আর অপরিকল্পিতভাবে গভীর ও অগভীর নলকূপ দ্বারা এই পানি উত্তোলনের ফলে সারাদেশেই ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়, প্রতিবছর ভূগর্ভের পানির স্তর দুই থেকে তিন মিটার করে নিচে নামছে। ভূ-গর্ভের পানির ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা না হলে আগামী এক দশক পর আরও আশঙ্কাজনক হারে পানির স্তর নিচে নেমে যাবে এবং আর্সেনিকের পরিমাণও বাড়বে। তখন নানা ধরনের দুর্ঘটনারও আশঙ্কা করা হয়েছে ওই গবেষণায়। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) এক গবেষণায় দেখা যায়, ষাটের দশকে ৫০ ফুট নিচ থেকে গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উঠানো যেত। কিন্তু এখন ১৫০ ফুট নিচ থেকে পানি তুলতে হয়। গবেষণায় আরও দেখানো হয়েছে, সাধারণত মাটির নিচ থেকে যে পানি উঠানো হয় সেটি নদী, খালবিল ও মাটি থেকে তৈরি হওয়া। পানি উঠালে প্রাকৃতিকভাবেই আবার পানি চলে আসত। কিন্তু এখন আর ভূ-গর্ভে সেই পানি যায় না। এর কারণ সেচব্যবস্থা। বোরো মৌসুমে প্রতিবছর যে হারে পানি সেচের জন্য ভূ-গর্ভ থেকে তোলা হয়, সে পরিমাণ পানি মাটির নিচে যায় না। ফলে পানির স্তর আরও নিচে নেমে যায়। এ কারণে অগভীর তো দূরের কথা, গভীর নলকূপ দিয়েও অনেক জায়গায় পানি পাওয়া যায় না। গভীর-অগভীর নলকূপে শ্যালো মেশিন দিয়ে কয়েক বছর ধরে বিকল্প ব্যবস্থায় সেচ কার্যক্রম চালাচ্ছে কৃষক। কিন্তু ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা। ১০ বছর আগে যেখানে ৬০-৭০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত, সেখানে পানি পেতে হলে এখন ১০০ থেকে ১২০ ফুট গভীরে যেতে হচ্ছে। বাংলাদেশের উজানে ভারত গঙ্গায় বাঁধ দেয়ার কারণে বহু আগেই পদ্মা নদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। পদ্মা ও এর শাখা নদীগুলো এখন ধু ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। এক হিসেবে দেখা গেছে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ নলকূপ রয়েছে। এই নলকূপ থেকে সেচের জন্য, খাওয়ার জন্য ও শিল্পের জন্য পানি তোলা হয়ে থাকে। ফলে আমাদের পাতাল পানি বা গ্রাউন্ড ওয়াটারের লেভেল প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫ মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। দেশে বৃষ্টির পরিমাণ দুই মিটার। তা থেকে ১ মিটার পানি রিচার্জ হয়। এ ছাড়া বর্ষার সময় নদীর কূল ছাপিয়ে পানি যখন ক্ষেত-খামার ও জলাভূমিতে ঢুকে যায়, সেখান থেকে বাকি চার মিটার পানি রিচার্জ হতো। কিন্তু বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নেয়ার কারণে আমাদের পাতাল পানি রিচার্জ হচ্ছে না। ফলে গ্রাউন্ড পানির লেভেল প্রতিবছর নিচে নেমে যাচ্ছে।
পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ ও বাংলাদেশ পানি বিধিমালা ২০১৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়া ব্যবহার সেচের পানি সুষ্ঠু ব্যবহার করে ফসল উৎপাদনে নিবিড়তা ও ফলন বৃদ্ধির জন্য সুপরিকল্পিত সেচ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সমন্বিত ক্ষুদ্রসেচ নীতিমালা ২০১৭ প্রণয়ন করেছে। এই নীতিমালায় সেচযন্ত্র স্থাপনে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, ‘সেচযন্ত্রের স্থান ও দূরত্ব নির্ধারণ করে সেচযন্ত্র স্থাপনের অনুমোদন, সেচযন্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, জেলা ও উপজেলায় সেচ সংক্রান্ত বিষয়ে সৃষ্ট বিরোধ মীমাংসা করা, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ক্ষুদ্রসেচ প্রকল্পের অনুমোদনের ব্যবস্থা করা। সেচ কার্যক্রম তদারকি ও সমন্বয়ের জন্য উপজেলা ও জেলা সেচ কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়েছে নীতিমালায়। এছাড়া উক্ত নীতিমালায় পানি ব্যবহারের বিষয়ে বলা হয়েছে, অঞ্চলভিত্তিক পানির প্রাপ্যতা, পানির ব্যবহারের প্রকৃতি ও সম্ভাব্যতা বিবেচনায় হাওড়, পাহাড়ী এলাকা, বরেন্দ্র এলাকা, চরাঞ্চল, উপকূলীয় অঞ্চলে সেচের পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার, ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা, বৃষ্টির পানি ব্যবস্থাপনা, গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপ, সমবায়ভিত্তিক পুকুর, নাল, খাল পুনঃখনন, সম্পূরক সেচ ও পানির অর্থনৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যমান পানি সম্পদের পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করা, সেচ কাজে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভূ-উপরিস্থ ও ভূ-গর্ভস্থ পানি সম্পদের উন্নয়ন করা, পানি সম্পদের এফিশিয়েন্ট ব্যবহারের উদ্দেশ্য নিয়ে এই নীতিমালা করা হয়েছে। উল্লেখ্য এলাকাভিত্তিক আলাদা সেচ ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু মনিটরিং সিস্টেমে আনার জন্য দু’টি কমিটিও করা হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার কে সভাপতি এবং জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসককে সভাপতি করে পৃথক দুইটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারা সেচ বিষয়ে সকল কার্যক্রম সুপারভিশন করবে।
কাব্য চরণ দিয়ে শুরু করে ভূগর্ভস্থ পানির নানা বিষয় এতক্ষণ জানালাম। সর্বশেষ কথা হলো ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের অবনমন ঠেকাতে করণীয় কী? সোজাসাপ্টা উত্তর হলো ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে মানুষের সচেতনতা এবং নিম্নোক্ত বিষয় সমূহে বিশেষ নজর-
১. নিয়ন্ত্রিত পানি উত্তোলন: কৃষি, শিল্প ও গৃহস্থালিতে ভূগর্ভস্থ পানির অপচয় রোধ করা।
২. বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ: রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং ব্যবস্থা চালু করা ও ভূগর্ভস্থ জলস্তর পুনরায় পূরণ করা।
৩. জলাভূমি এলাকা সংরক্ষণ: জলাধার, পুকুর, খাল, নদী এবং জলাভূমি সংরক্ষণ ও পুনঃখনন করা।
৪. সেচ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন: ড্রিপ ও স্প্রিঙ্কলার সেচ পদ্ধতি ব্যবহার করা, যাতে কম পানিতে চাষ সম্ভব হয়।
৫. শহরায়ন নিয়ন্ত্রণ: কংক্রিটের রাস্তা ও ভবনের সংখ্যা কমিয়ে খোলা জায়গা বাড়ানো, যাতে পানি মাটিতে প্রবেশ করতে পারে।
৬. গাছ লাগানো ও বন সংরক্ষণ: বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে মাটির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
৭. আইন ও নীতিমালা প্রয়োগ: ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ ও পরিবেশগত বিধি মেনে চলা।
৮. সচেতনতা বৃদ্ধি: ভূগর্ভস্থ পানির গুরুত্ব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা এবং পানির অপচয় রোধে উদ্যোগ নেওয়া।