সোনার তরী কবিতায় রূপকের স্তরবিন্যাসে বর্ষাকালীন প্রতিকূল পরিবেশে ধান কাটতে যাওয়া এক কৃষকের অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। চারপাশে প্রবল স্রোতের বিস্তার, এমনই একখানি ছোটো খেতের মাঝখানে সোনার ধান নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন এক বিপন্ন কৃষক। আকাশের ঘন মেঘ আর ভারী বর্ষণে পাশের খরস্রোতা নদী হয়ে উঠেছে আরও হিংস্র’ ও ক্ষিপ্ত। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিঃসঙ্গ কৃষকের মনে দানা বাঁধতে থাকে অজানা আশঙ্কা । এমন সময় সেখানে ভরা পালে সোনার তরী বেয়ে আসে এক রহস্যময় নেয়ে। কৃষকের তাকে চেনা মনে হয়। উৎকণ্ঠিত কৃষক তাঁর উৎপাদিত সোনার ধানের সবটুকু তুলে দেন নৌকায়। অবাক হয়ে তিনি দেখেন নৌকায় ফসল ধরলেও তাঁর জন্য সেখানে বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। পরিশেষে সোনার ধান নিয়ে তরী চলে যায় অজানা দেশে। শূন্য নদীতীরে অপূর্ণতার বেদনা নিয়ে কৃষক দাঁড়িয়ে থাকেন একা। এমন চিত্রকল্পের আড়ালে এখানে অন্তর্লীন রয়েছে একটি জীবনদর্শন। আর তা হলো— মহাকালের স্রোতে অনিবার্যভাবেই মানুষ একসময় হারিয়ে যায়, যদিও তার কীর্তির মৃত্যু হয় না।
সর্বোপরি, জগতে এক শ্রেণির মানুষ কাজ করে কালের গর্ভে হারিয়ে যায়, কর্ম মানুষটিকে বাঁচিয়ে রাখে যুগের পর যুগ। অপরদিকে আরেকটা শ্রেণি আছে যারা কাজ কর্মের ধার ধারে না, তারাও কালের ইতিহাসে টিকে থাকতে চায়, কিন্তু তাদের এই চাওয়া কখনো টেকসই হয় না। অন্যভাবে বললে, জগতের বিখ্যাত ও কুখ্যাত দুই শ্রেণীর মানুষকেই ইতিহাস তার পাতায় লিখে রাখে। মানুষ সুযোগ পেলে স্মরণ করে এদের উভয়েই, তবে বিখ্যাত কে স্মরণ করে শ্রদ্ধাভরে আর কুখ্যাত কে স্মরণ কে ঘৃণা ভরে বকা দিয়ে। পৃথিবীর দশহাজার বছরের সভ্য ইতিহাস বলে, Nature Justice কাউকে ক্ষমা করেনি এবং করবে না। কিছু মানুষ মারা গিয়ে বেছে থাকে আজীবন আর কিছু মানুষ নিক্ষিপ্ত হয় আঁস্তাকুড়ে। কে কোনটা হবে, এটা ব্যক্তির একক সিদ্ধান্ত। সৃষ্টিকর্তা সেরা জীব মানুষকে এই পছন্দের সুযোগ দিয়েছে।