শিরোনাম :
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদে ১১৫টি নির্বাচনী প্রতীক, তালিকায় নেই শাপলা।আম, আনারস ও আপেলে নজর নেই এনসিপির উজানচর-ঘাগুটিয়া খেয়াঘাটে বজ্রপাতের আঘাতে তিনজনের মর্মান্তিক মৃত্যু। টেকনাফে হ্নীলা নিখোঁজ শিশু কন্যার মৃতদেহ পুকুর থেকে উদ্ধার, আটক- ৬ কাইতলা দক্ষিণ ইউনিয়নে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’র কর্মী ও সুধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত জন্মভূমি নবীনগরে মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত কামরুজ্জামানের সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগদান জন্মভূমি নবীনগরে ডিআইজি মোঃ মনিরুজ্জামানের সংক্ষিপ্ত সফর শীঘ্রই সেনবাগে শুরু হতে যাচ্ছে “শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্মৃতি পৌর ক্রিকেট লীগ ২০২৫” নোয়াখালীতে গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে একই পরিবারের ৪জন দগ্ধ নবীনগরে বিশেষ অভিযানে অবৈধ বন্দুকসহ যুবক আটক,নির্দোষ দাবি করে গ্রামবাসীর মানববন্ধন
শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৩৩ অপরাহ্ন

বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস: প্রাণঘাতী এক রোগ প্রতিরোধে বৈশ্বিক অঙ্গীকার।

প্রতিনিধির নাম / ২২৮ বার
আপডেট : সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
Oplus_131072

বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস: প্রাণঘাতী এক রোগ প্রতিরোধে বৈশ্বিক অঙ্গীকার।

বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর ২৮ সেপ্টেম্বর পালিত হয় বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস। এই দিবসের সূচনালগ্ন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এর গুরুত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। জলাতঙ্ক এমন এক সংক্রামক ভাইরাসজনিত রোগ যা মানুষের জীবনকে মুহূর্তের মধ্যেই বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে এবং চিকিৎসা না পেলে শতভাগ মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, সরকার ও জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ মিলে জলাতঙ্ক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে এই দিবসকে বিশেষ তাৎপর্যের সাথে পালন করে থাকে। এই দিনটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বৈজ্ঞানিক ইতিহাস, চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাফল্য এবং একইসাথে জনসচেতনতার গভীর প্রয়োজনীয়তা। দিবসটির তারিখও কাকতালীয়ভাবে নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক তাৎপর্য। ১৮৯৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মহান বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর মৃত্যুবরণ করেন। তিনি প্রথমবারের মতো জলাতঙ্কের টিকা আবিষ্কার করে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং মানবজাতিকে জলাতঙ্কের ভয়ালতা থেকে রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে দিনটিকে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০৭ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বব্যাপী দিনটি পালিত হতে শুরু করে এবং তখন থেকেই এটি জনসচেতনতা সৃষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

জলাতঙ্ক একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যার জীবাণু রেবিস ভাইরাস নামে পরিচিত। এটি লিসাভাইরাস গণভুক্ত এবং সাধারণত স্তন্যপায়ী প্রাণীর শরীরে বাস করে। ভাইরাসটি আক্রান্ত প্রাণীর লালা থেকে ছড়িয়ে থাকে। কুকুর জলাতঙ্ক সংক্রমণের সবচেয়ে বড় বাহক, যদিও বিড়াল, শিয়াল, বাদুড়, নেকড়ে কিংবা অন্যান্য বন্যপ্রাণীর মাধ্যমেও এটি ছড়াতে পারে। সংক্রমণ ঘটে মূলত কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমে, আবার আক্রান্ত প্রাণীর লালা যদি মানুষের কাটা ঘা বা শ্লেষ্মা ঝিল্লিতে প্রবেশ করে তবে তাতেও ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করতে পারে। ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করার পর স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব ফেলে এবং মস্তিষ্কে প্রদাহ সৃষ্টি করে। এর ফলে দেখা দেয় ভয়ঙ্কর স্নায়বিক জটিলতা। শুরুতে সাধারণ জ্বর, মাথাব্যথা, অস্বস্তি কিংবা অবসাদ অনুভূত হলেও ধীরে ধীরে ভয়, উদ্বেগ, বিভ্রম, খিঁচুনি এবং বিশেষত পানি বা বাতাসের প্রতি ভীতি তৈরি হয়। একে বলা হয় হাইড্রোফোবিয়া। রোগের অগ্রগতির সাথে সাথে শ্বাসকষ্ট, পক্ষাঘাত এবং অবশেষে মৃত্যু ঘটে। একবার উপসর্গ দেখা দিলে এর কার্যকর চিকিৎসা নেই, তাই প্রতিরোধই একমাত্র সমাধান।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর প্রায় ৫৯ হাজার মানুষ জলাতঙ্কে মারা যায় এবং এদের প্রায় ৯৫ শতাংশই এশিয়া ও আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোতে বসবাস করে। শিশুদের মধ্যে এর প্রকোপ বিশেষভাবে বেশি, কারণ তারা সচরাচর প্রাণীর সঙ্গে খেলা করে কিংবা অসতর্কভাবে কুকুরের সংস্পর্শে চলে আসে। বাংলাদেশেও জলাতঙ্ক একটি উল্লেখযোগ্য জনস্বাস্থ্য সমস্যা। অনেক বছর ধরে গ্রামীণ জনপদে কুকুরের কামড়ে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগে কুকুর টিকাদান কর্মসূচি, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং বিনামূল্যে ভ্যাকসিন প্রদানের ফলে মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।

জলাতঙ্ক প্রতিরোধের প্রধান উপায় হলো আক্রান্ত প্রাণীর কামড় বা আঁচড় খাওয়ার সাথে সাথেই প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করা। প্রথমত, ক্ষতস্থান প্রচুর সাবান ও পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে কমপক্ষে ১৫ মিনিট ধরে। এটি ভাইরাস ধ্বংসের সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলোর একটি। এরপর যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে জলাতঙ্কের ভ্যাকসিনের পাশাপাশি প্রয়োজনে রেবিস ইমিউনোগ্লোবুলিন দেওয়া হয়। যারা নিয়মিত প্রাণীর সংস্পর্শে থাকেন যেমন পশুচিকিৎসক, প্রাণী নিয়ন্ত্রণ কর্মী কিংবা ল্যাবরেটরি কর্মীদের জন্য প্রাক-প্রতিরোধমূলক টিকা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। একইসাথে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো গৃহপালিত কুকুর ও বিড়ালকে নিয়মিত টিকা দেওয়া। কারণ প্রাণীদের মধ্য থেকে ভাইরাস নির্মূল হলে মানুষের মধ্যে সংক্রমণের সম্ভাবনাও কমে যাবে। জলাতঙ্ক প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা অপরিহার্য। অনেক মানুষ এখনো মনে করে কুকুর কামড়ালে স্থানীয় কবিরাজের কাছে যাওয়াই যথেষ্ট। এই ধরনের কুসংস্কার পরিত্যাগ করে বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার প্রতি আস্থা স্থাপন করতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি গ্রামীণ জনপদে স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে জনসচেতনতা কর্মসূচি চালানো জরুরি। একইসাথে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং স্থানীয় সংগঠনগুলোর সমন্বিত প্রচারণা চালাতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব প্রাণী স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে জলাতঙ্ককে বৈশ্বিকভাবে নির্মূল করার লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। এর জন্য প্রতিটি দেশকে নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে টিকাদান কর্মসূচি, গবেষণা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

জলাতঙ্ক দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রতিটি মানুষের জীবন মূল্যবান এবং একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগের কারণে কোনো মৃত্যু হওয়া উচিত নয়। বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, কার্যকর টিকা এবং সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে জলাতঙ্ক নির্মূল করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আর্থিক বিনিয়োগ ও সামাজিক অংশগ্রহণ। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশ যদি এ লক্ষ্য অর্জনে একসাথে কাজ করে তবে একদিন মানবজাতি জলাতঙ্কমুক্ত বিশ্বে বসবাস করতে পারবে। প্রতিটি বছর এই দিবসটি আমাদের নতুনভাবে দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয় যে আক্রান্ত প্রাণীর টিকা, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার মাধ্যমে আমরা এই প্রাণঘাতী রোগকে ইতিহাসের পাতায় স্থানান্তর করতে পারি। জলাতঙ্কের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানের নয়, বরং এটি মানবতার সংগ্রাম। প্রতিটি শিশুর হাসি, প্রতিটি পরিবারের নিরাপত্তা এবং প্রতিটি জীবনের প্রতি আমাদের সম্মান জানানোই এই দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য। তাই আসুন, বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবসে আমরা সকলে শপথ নিই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করব, সচেতনতা ছড়াবো এবং একদিন এ পৃথিবীকে জলাতঙ্কমুক্ত করে তুলব।

লেখক ঃ মোঃ মোশাররফ হোসাইন

উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

 

Facebook Comments Box


এ জাতীয় আরো সংবাদ