“চিঠি দিও প্রতিদিন, চিঠি দিও/নইলে থাকতে পারবো না/চিঠিগুলো অনেক বড় হবে/পড়তে পড়তে সকাল দুপুর আর রাত্রি চলে যাবে/কোথায় থাকো, কেমন থাকো একে একে সবই লিখো। সেই তো হবে মোর সান্ত্বনা।”
উপরে বর্ণিত গানটি গেয়েছেন প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী সাবিনা ইয়াসমীন। চিঠির গুরুত্ব বুঝাতে আশির দশকের বাংলা ছবি ‘অনুরোধ’-এর একটি জনপ্রিয় গানের কয়েকটি কলি এখানে উদ্ধৃত করা হলো। নায়কের অনুপস্থিতিতে বিরহকাতর নায়িকা গানের মাধ্যমে তার হৃদয়ের একান্ত আবেগ প্রকাশ করছেন এখানে। একটা সময় সমগ্র বিশ্ব জুড়েই চিঠি ছিল একটি আবেগের নাম। কিন্তু আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ইন্টারনেটসহ তথ্য প্রযুক্তির বিকাশের ফলে এসএমএস, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ আর ইমেইলের দ্রুততার যুগে কাগজের চিঠি, পথপানে চেয়ে থাকা আর ডাকপিয়নের ঘণ্টাধ্বনি বর্তমান প্রজন্মের কাছে যেন রূপকথার গল্প। একসময়ের জমজমাট পোস্ট অফিসগুলো এখন অনেকটা অবহেলিত পরিত্যক্ত বস্তুতে পরিণত হয়েছে। কালের পরিক্রমায় চিঠির প্রচলন কমে গেলেও আগে এই চিঠি ছিল যোগাযোগের প্রধানতম মাধ্যম। এখন মনে চাইলেই টুক করে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আগে কোনো খবর দূরে কাউকে জানানোর জন্য বেশ সময় লাগত। কখনো গুনতে হতো দিন, কখনোবা মাস। তবে যাই হোক, চিঠি পাওয়ার মতো আনন্দের সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা হয় না। চিঠি পেলে আমাদের আনন্দের সীমা থাকে না। চিঠিকে বহু সাহিত্যিক তুলনা করেছেন শিল্পের সঙ্গে, অনেক গীতিকার চিঠি নিয়ে লিখেছেন গান। ‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’। যুদ্ধের ময়দান থেকে শুরু করে বন্ধুত্ব, প্রেম কিংবা দাপ্তরিক কাজ, কোথায় ছিল না চিঠি? তবে আজ যে চিঠি আর সেভাবে নেই, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
এই হারিয়ে যাওয়া শিল্পকে ধরে রাখতে তাই প্রতিবছর ১ সেপ্টেম্বর পালিত হয়ে আসছে ‘আন্তর্জাতিক চিঠি দিবস’।
২০১৪ সালে প্রথম অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক রিচার্ড সিম্পকিনের হাত ধরে এই দিবসের প্রচলন শুরু হয়। নব্বই দশকের শেষের দিকে সিম্পকিন নিজ দেশের বড় ব্যক্তিত্বদের চিঠি পাঠাতেন। অনেক সময় সেই চিঠির উত্তর পেতেন না। তবে যখন পেতেন, তখন তাঁর আনন্দের সীমা থাকত না। এই আনন্দ নাকি তাঁর কাজকর্মে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিত। সেই ভালোবাসা থেকে সিম্পকিন ২০১৪ সালে এই দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি চান চিঠি লেখার চর্চা আবার ফিরে আসুক। মোবাইল, টেলিফোন এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির যুগ আসার পর থেকে কেউ আর কাউকে কষ্ট করে চিঠি পাঠায় না। প্রয়োজনীয় সব কথা তাতেই সেরে ফেলা যায়। অথচ আগে মানুষ মনের পুরোপুরি ভাব, আবেগ, না বলা সব জমানো কথা সুবিন্যস্ত আকারে যত্ন করে চিঠিতে করেই লিখত প্রিয়জনকে। আজকের এই যুগে যা বিলুপ্তির পথে। এমনকি হাতে চিঠি লিখে পাঠানো আজকাল অপ্রয়োজনীয় কাজ মনে করা হয়। কিন্তু আমরা যদি অতীতের দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব আজকের মেসেঞ্জার, ইমেইল, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদির অবর্তমানে এই চিঠিই ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। অতীতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের পর্যালোচনার জন্য আজও গবেষকরা পুরাতন চিঠির ওপর নির্ভরশীল।
পৃথিবীতে কে কখন কাকে প্রথম চিঠি লিখেছে সে বিষয়ে তথ্য আজও অজানা। তবে বহু বছর আগে মেসোপটেমিয়ার সুমেরিয়ান অঞ্চলে মানুষ ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশ করত। যেমন আকাশের তারা দিয়ে বোঝানো হতো রাত, কিংবা তীর ও ধনুকের ছবি দিয়ে বোঝানো হতো যুদ্ধের বর্ণনাকে। ছবির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশের এই মাধ্যমের নাম ছিল পিক্টোগ্রাম (Pictogram)। চিঠিকেই বলা হয় এই পিক্টোগ্রামের বিবর্তিত রূপ। ঐতিহাসিকভাবে, চিঠির প্রচলন ছিল প্রাচীন ভারত, প্রাচীন মিসর, সুমেরীয় সভ্যতায়, প্রাচীন রোম ও চীনে। এই ইন্টারনেটের যুগেও কদাচিৎ এর দেখা মেলে। সতেরো ও আঠারো শতকে চিঠি লেখা হতো স্বশিক্ষার জন্য। চিঠি ছিল পাঠচর্চা, অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা, বিতর্কমূলক লেখা বা সমমনা অন্যদের সঙ্গে আইডিয়া বিনিময়ের পদ্ধতি। কিছু লোক চিঠিকে মনে করত কেবলই লেখালেখি। আবার অন্যরা মনে করত যোগাযোগের মাধ্যম। বাইবেলের বেশ কয়েকটি পরিচ্ছেদ চিঠিতে লেখা। ব্যক্তিগত, কূটনৈতিক বা বাণিজ্যিক সবরকম চিঠিই ঐতিহাসিকরা ইতিহাসের প্রাথমিক তথ্য উৎস হিসেবে ব্যবহার করেন। কখনো-বা চিঠি এত শৈল্পিক রূপ পায় যে তা সাহিত্যের একটি অংশ হয়ে ওঠে, যেমন বাইজেন্টাইনে এপিস্টোলোগ্রাফি বা সাহিত্যের পত্রউপন্যাস।
বাংলা সাহিত্যে চিঠিপত্র নিয়ে লিখতে গেলে অনেক লেখা যাবে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিঠি ছিল উল্লেখযোগ্য সম্পদ। বাংলা সাহিত্যে চিঠিকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে একের পর এক পত্রসাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যারা ভালো চিঠি লেখে তারা মনের জানালার ধারে বসে আলাপ করে যায় তার কোনো ভাব নেই, বেগও নেই, স্রোত আছে। ভাবহীন সহজের রসই হচ্ছে চিঠির রস।’ বাংলা পত্রসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথ বিচিত্রধর্মী অসংখ্য পত্র লিখেছেন, অনেক পত্র তার ভ্রমণ ডায়েরির মতো। পত্র অভিধাযুক্ত পুস্তকাকারে প্রকাশিত সেই গ্রন্থগুলো হলো ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’, ‘জাভা-যাত্রীর পত্র’, ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’, ‘রাশিয়ার চিঠি’, ‘ছিন্নপত্র’ এবং কয়েক খণ্ডে প্রকাশিত ‘চিঠিপত্র’। পত্রসাহিত্যের ক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দের পত্রাবলির কথাও সশ্রদ্ধায় স্মরণীয়। বিবেকানন্দের অধিকাংশ রচনা ইংরেজি ভাষায় রচিত। বাংলায় লিখিত গ্রন্থ মাত্র কয়েকখানি। তার চিঠিপত্র এই বাংলা রচনার অসামান্য স্বাক্ষর। তিনি চিঠিপত্রে শিষ্য ও গুরুভ্রাতাদের নানা তত্ত্বোপদেশ দিতেন, আলোচনা করতেন। তত্ত্বকথা ও উপদেশের অন্তরালে সহজ, সরল ভাষায় তার ব্যক্তিমনের অন্তরঙ্গ রূপটি এই পত্রাবলিকে সাহিত্যের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। পত্রাবলি হয়ে উঠেছে পত্রসাহিত্য। আর তাই এই চিঠিগুলো পত্রসাহিত্যের এক মূল্যবান সামগ্রীরূপে গণ্য হওয়ার যোগ্য। এছাড়াও মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য, কাজী নজরুল ইসলামের পত্রোপন্যাস ‘বাঁধন হারা’ বাংলা পত্রসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আজ এতটাই উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে যে, এখন আর কেউ কষ্ট করে প্রিয়জনকে চিঠিপত্র লেখে না। কথা বলা ও পরস্পর যোগাযোগের জন্য এখন চারপাশে নানান উপায় উপকরণ বিদ্যমান। কাগজের চিঠি দুই একটি আনুষ্ঠানিক ও দাপ্তরিক প্রয়োজনে ছাড়া কোথাও তেমন ব্যবহার হয় না বললেই চলে। যেমন, নিয়োগপত্র বা পদত্যাগপত্র, বিভিন্ন দাপ্তরিক আদেশ বা নির্দেশপত্র, বিবাহের নিমন্ত্রণপত্র ইত্যাদি গুটিকয়েক ক্ষেত্রেই কাগজের চিঠির ব্যবহার দেখা যায়। এই যুগে চিঠির নানা বিকল্প আছে, তারপরেও প্রাচীন এই যোগাযোগ-ব্যবস্থাটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য হলেও আমাদের মাঝেমধ্যে চিঠিপত্র লেখা উচিত। হঠাৎ কোনো বিশেষ উপলক্ষকে ঘিরে অথবা উপলক্ষহীন এমনিতেই প্রিয়জনের কাছে চিঠি লিখে তাদের চমকে দিতে পারি চাইলেই। কারণ চিঠিতে মিশে থাকে ব্যক্তি মানুষের স্পর্শ ও অনুভূতি। এতে অল্পতেই তারা চমকিত ও আনন্দিত হবে- তেমনি বিলুপ্তিও ঘটবে না প্রাচীন এই প্রথাটিরও।
লেখকঃ মোঃ মোশাররফ হোসাইন
উপজেলা নির্বাহী অফিসার
সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া