ইসলামে কোরবানির ইতিহাস, ধর্মীয় গুরুত্ব ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ।
মোশারফ হোসাইন উপজেলা নির্বাহী অফিসার সরাইল ব্রাহ্মণবাড়িয়াঃ
ইসলাম ধর্মে কোরবানির ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন ও তাৎপর্যপূর্ণ। এর সূচনা ঘটে হযরত আদম (আ.)-এর যুগে, যেখানে তাঁর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি প্রদান করেছিলেন। পবিত্র কোরআনে এ ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে সুরা মায়েদার ২৭তম আয়াতে, যেখানে বলা হয়েছে, “আর আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের ঘটনা সঠিকভাবে শুনিয়ে দিন, যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল; অতঃপর তাদের একজনের কোরবানি কবুল করা হলো এবং অপরজনের কবুল করা হলো না।” এই আয়াত থেকে প্রমাণিত হয়, কোরবানি শুধুই একটিমাত্র ধর্মীয় রীতি নয়, বরং তা পরহেজগারির অন্যতম প্রতীক। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তেই এই আত্মত্যাগের চর্চা অব্যাহত রয়েছে ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই।
কোরবানির ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং হৃদয়স্পর্শী অধ্যায় হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর আত্মত্যাগ। ইব্রাহিম (আ.) এক রাতে স্বপ্নে দেখেন, তিনি তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাঈলকে আল্লাহর আদেশে কোরবানি করছেন। পিতার এই বর্ণনা শুনে পুত্র ইসমাঈল নির্দ্বিধায় বলেন, “হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, তাই করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” আল্লাহ তাআলা এই নিঃস্বার্থ আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ দেখে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন এবং ইসমাঈলের পরিবর্তে একটি বড় আকারের পশু জবাই করার নির্দেশ দেন। এই ঘটনাই প্রতিফলিত হয় ঈদুল আজহার দিনে মুসলিমদের দ্বারা কোরবানির মাধ্যমে, যা এখন বিশ্বজুড়ে মুসলিম উম্মাহ পালন করে আসছে। কোরআনের সুরা সাফফাত এবং সুরা হজে এই ঘটনাগুলো বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে, যা কোরবানির ধর্মীয় ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে।ইসলামে কোরবানিকে একটি ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, যার উদ্দেশ্য কেবল মাংস আহরণ নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আত্মশুদ্ধির অনুশীলন। সুরা হজের ৩৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তাদের মাংস ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না; কিন্তু তোমাদের তাকওয়া তাঁর কাছে পৌঁছে।” এই আয়াত দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে, মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এবং নিজের ভেতরের অহংকার, স্বার্থপরতা ও বস্তুগত লোভ পরিত্যাগ করা।
কোরবানির পশু নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ইসলামে নির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা রয়েছে। পশুর বয়স, স্বাস্থ্য, সুস্থতা এবং শারীরিক দোষত্রুটি বিবেচনা করে কোরবানি করার বিধান রয়েছে। যেমন গরু ও মহিষের বয়স কমপক্ষে দুই বছর, ছাগল ও ভেড়ার বয়স এক বছর হতে হয় এবং পশু দৃষ্টিহীন, পঙ্গু বা খুব দুর্বল হলে তা কোরবানির উপযোগী নয়। এতে পশুর প্রতি দয়া ও মানবিক আচরণের বার্তা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। জবাইয়ের পদ্ধতিতে ইসলাম এমন একটি পন্থা নির্ধারণ করেছে যা পশুর জন্য অত্যন্ত দয়ার এবং বৈজ্ঞানিকভাবে উপকারী। ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী, জবাইয়ের সময় ধারালো ছুরি ব্যবহার করে দ্রুততার সঙ্গে খাদ্যনালী, শ্বাসনালী ও দুটি মূল রক্তনালী কাটা হয় এবং আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়। এটি পশুর যন্ত্রণা হ্রাস করে এবং তার রক্ত দ্রুত শরীর থেকে বের করে দেয়, ফলে মাংস টক্সিনমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত হয়। হাদিসে এসেছে, “তোমরা জবাই ভালোভাবে করো, ছুরি ধারালো করো এবং পশুকে কষ্ট দিও না।”
এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাও ইসলামি পদ্ধতির সপক্ষে কথা বলে। জার্মানির হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর উইলহেল্ম শুলজে এবং ড. হাজিম পরিচালিত একটি বিখ্যাত গবেষণায় দেখা গেছে যে, ইসলামি পদ্ধতিতে জবাই করা পশুর মস্তিষ্কে ব্যথার সংবেদন কম হয় এবং সে ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে যায়। এই গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, ইসলামি পদ্ধতিতে জবাই করা পশুর হৃদস্পন্দন কিছুক্ষণ সচল থাকে, ফলে শরীরের সমস্ত রক্ত বেরিয়ে যায়, যা জীবাণু সংক্রমণ রোধ করে এবং মাংসকে দীর্ঘস্থায়ী ও নিরাপদ করে তোলে। চিকিৎসা বিজ্ঞান মতে, এই পদ্ধতিতে জবাই করা মাংসে ব্যাকটেরিয়া, টক্সিন এবং পচন ধরার সম্ভাবনা অনেক কম থাকে। ফলে মানুষের জন্য তা অধিক স্বাস্থ্যকর হয়। অন্যদিকে, যেসব পদ্ধতিতে পশুকে বিদ্যুৎ শক, গলা টিপে কিংবা যন্ত্রের সাহায্যে হত্যা করা হয়, সেসব পদ্ধতিতে পশুর দেহে রক্ত জমে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে বিষাক্ত পদার্থ ও ব্যাকটেরিয়া থেকে যায়, যা মানবদেহে ক্যানসার, কিডনি রোগ, এবং অন্যান্য জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এই কারণেই বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা হালাল ও ইসলামি জবাই পদ্ধতির স্বাস্থ্য উপযোগিতা এবং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
মুসলিম উম্মাহর জন্য কোরবানি একটি আত্মিক সংযমের অনুশীলন, যার মাধ্যমে ব্যক্তি তার ভেতরের পশুত্বকে পরাজিত করে। এটি কেবল একটি আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং একটি গভীর আত্মশুদ্ধি, আত্মত্যাগ এবং মানবতার প্রতি ভালোবাসার শিক্ষা। ইসলামের কোরবানি ব্যবস্থায় যেমন রয়েছে ইতিহাসের গুরুত্ব, তেমনি রয়েছে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার সুস্পষ্ট বার্তা। যারা কোরবানিকে শুধু একটি রীতি হিসেবে দেখে, তারা এর অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিকতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়। আজকের আধুনিক বিশ্বে, যেখানে পশু কল্যাণ, স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পরিবেশগত ভারসাম্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ, সেখানে ইসলামি কোরবানির পদ্ধতি একটি ব্যতিক্রমী মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই পদ্ধতির প্রতিটি ধাপে যেমন পশুর প্রতি দয়া ও শ্রদ্ধা দেখানো হয়, তেমনি মানুষের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হয়। অতএব, ইসলামে কোরবানি শুধু একটি ঐতিহাসিক বা ধর্মীয় প্রথা নয়, বরং এটি একটি মানবিক, স্বাস্থ্যসম্মত এবং পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা যা যুগে যুগে প্রাসঙ্গিক ও জরুরি হয়ে উঠেছে।
এই ইতিহাস, বিশ্বাস, রীতি এবং বিজ্ঞানের মেলবন্ধনই কোরবানিকে করে তোলে ইসলামি জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর এই আত্মত্যাগের শিক্ষাই প্রতিফলিত হয় ঈদুল আজহার মহান আদর্শে, যা প্রতি বছর মুসলিম বিশ্বে বিশ্বাস, ভালোবাসা এবং আত্মোৎসর্গের এক অনন্য নজির স্থাপন করে।