আগামীকাল পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন: পালনের আদ্যোপান্ত।
এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক,
পহেলা বৈশাখের উৎসব শুরু হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনপ্রিয় ‘এসো হে বৈশাখ’ গান গেয়ে। এই গানের কথা ও সুরের সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। শুরু করেছি গান দিয়ে তাই পুরো আলোচনায়ই গান নিয়ে করব তা কিন্তু নয় আজ আমারা জানার চেষ্টা করব বৈশাখের আদ্যোপান্ত। ইংরেজি নববর্ষ পহেলা জানুয়ারি আর বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ উদযাপনের একটা বড়ো পার্থক্য হল, ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন করা হয় ঠিক রাত ১২টা থেকে। আর বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয় ঠিক সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই। কারণ বাংলা রীতিতে দিন শুরু হয় সূর্য ওঠার সময় থেকে। আধুনিক বাংলা নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ব্রিটিশ আমলে ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর আবার পহেলা বৈশাখ উদযাপনের খবর পাওয়া যায় ১৯৩৮ সালে। ১৯৬৭ সনের আগে বিশেষ করে পাকিস্তান আমলে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের কোনো বড়সড় চিত্র আর পরিলক্ষিত হয়নি।
পরাক্রমশালী মোগল সম্রাট আকবর ভারতবর্ষের ইতিহাসে নানা কারণে বিখ্যাত হয়ে আছেন। মোগল সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই সাম্রাজ্যের শাসনভার নেন জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর। তিনি সিংহাসনে বসার পরই আগ্রা ও দিল্লি দখল করে নেন আদিল শাহ শূরের সেনাপতি হিমু। আকবরকে আক্রমণ করতে আসেন হিমু। বৈরাম খানকে সঙ্গে নিয়ে হিমুর মোকাবিলায় নামেন আকবর। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হিমু পরাজিত হন সম্রাট আকবরের কাছে। তার এই বিজয় উদযাপন করতে এবং আরও সুবিধাজনক উপায়ে খাজনা আদায় করতে সম্রাট আকবর ইলাহী সন চালু করার ঘোষণা দেন।
মোঘল আমলে খাজনা আদায় করা হত চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী। চাঁদের উদয় অস্তের হিসেব করে গোনা হয় চান্দ্রবর্ষ যেমন, আরবি হিজরী সন হলো চান্দ্রবর্ষ। আর সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর পরিক্রমণের ওপর ভিত্তি করে হিসাব করা হয় সৌরবর্ষ যেমন, খ্রীষ্টবর্ষ বা ইংরেজি সন। তখনকার দিনে কৃষকদের খাজনা চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী দিতে হতো। কিন্তু কৃষক তার জমির ফসল ঘরে তুলতে পারতো একটি নিদিষ্ট সময় পর পর। কিন্তু চান্দ্রবর্ষ প্রতিবছর ১১ দিন করে এগিয়ে যেতো যা কৃষকের খাজনা দেয়া ও ফসল তোলার মধ্যে সমস্যা তৈরি করতো। এতে কৃষকের খাজনা দেওয়া কঠিন ব্যাপার হয়ে যেতো। বাদশাহ আকবর তার শাসনামলের শুরু থেকেই সহজ, বিজ্ঞানভিত্তিক ও কার্যকর পদ্ধতিতে বছরের হিসাব রাখার কথা ভাবছিলেন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার দায়িত্ব পড়ে সে সময়ের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোর্তিবিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীর ওপর। তার প্রচেষ্টায় ১৫৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ১০ কি ১১ মার্চ সম্রাট আকবর ‘ইলাহী সন’ নামে নতুন এক সন চালু হয়। সে সময়ের কৃষকশ্রেণীর কাছে এটি ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত হয়। পরে এটি ‘বঙ্গাব্দ’ নামেই পরিচিতি পায়। নতুন এই সালটি আকবরের রাজত্বের ২৯তম বর্ষে চালু হলেও তা গণনা আরম্ভ হয় ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে। কারণ ওই দিনেই দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে আকবর হিমুকে পরাজিত করেছিলেন।
গবেষণায় দেখা যায় শকাব্দ থেকেই বাংলা সনের নামগুলি এসেছে। শক রাজবংশের রাজারা যে সন গণনা শুরু করেছিলেন, সেটিই শকাব্দ। আর বাংলা মাসগুলির নামকরণ করা হয় আবার বিভিন্ন নক্ষত্রের নামে। যেমন, বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রাইহনী থেকে অগ্রহায়ণ, পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফল্গুনি থেকে ফাল্গুন, এবং চিত্রা থেকে চৈত্র। তবে অগ্রহায়ণ মাসের নামের আরেকটি ব্যাখ্যা আছে। অগ্র অর্থ প্রথম, হায়ণ অর্থ বর্ষ বা ধান। আগে এই মাস থেকেই বছর গণনা আরম্ভ হতো বা এই সময়ে প্রধান ফসল ধান কাটা হতো। আর তাই এই মাসের নাম হয় অগ্রহায়ণ। বর্তমানে সাতটি দিনের (শনি, রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার) নাম দিয়ে পুরো বছরের হিসাব রাখা যায়। কিন্তু আকবরের সময় মাসের প্রত্যেকটি দিনের জন্য আলাদা আলাদা নাম ছিল। এত নাম মনে রাখতে তখনকার লোকদের অনেক কষ্ট হতো। মানুষের এই কষ্ট দেখে সম্রাট শাহজাহান ভাবলেন, এই ব্যবস্থা তো বদলানো দরকার। ধারণা করা হয়, তিনি একজন বিদেশি পণ্ডিতের সাহায্য নিয়ে সাপ্তাহিক পদ্ধতিতে দিনের নামকরণ পদ্ধতি চালু করেন। যেমন, ইংরেজি দিনের নামের সঙ্গে বাংলা দিনের, মানে বারের নামের মিল রাখা হয়েছে। যেমন সানডে (Sunday) হলো রবিবার। ইংরেজি Sun (সান) অর্থ সূর্য্য বা রবি।
বাংলা বর্ষপঞ্জি বা বঙ্গাব্দ বাঙালির নিজস্ব সন হলেও, সারা বিশ্বের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রাখতে বাংলাদেশের সব জায়গাতেই খ্রিষ্টীয় সন ব্যবহার করা হয়। আর, খ্রিষ্টীয় সনে প্রতি চার বছর পর ফেব্রুয়ারি মাসে অতিরিক্ত ১ দিন যোগ করা হয়। একে লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ বলা হয়। খ্রিষ্টীয় সনের সঙ্গে বঙ্গাব্দের দিন তারিখের গরমিলের কারণে সাধারণ মানুষের পক্ষে উভয় সন গণনায় সমস্যা হতো। এ সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৬৬ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বাংলা একাডেমীর তত্তাবধানে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-এর নেতৃত্বে বঙ্গাব্দ সংষ্কার কমিটি তৈরি করা হয়। ওই কমিটি চার বছর পর পর চৈত্র মাস ৩০ দিনের পরিবর্তে ৩১ দিনে গণনা করার পরামর্শ দেয়। সেই সুপারিশ অনুযায়ী বৈশাখ থেকে ভাদ্র- এই পাঁচ মাসের প্রতি মাস ৩১ দিনে এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র, এই সাত মাস গণনা করা হয় ৩০ দিনে। অধিবর্ষে, মানে লিপ ইয়ারে চৈত্র মাসের দিনসংখ্যা হবে ৩১। অনেক সময় পেরিয়ে ১৯৮৮ সালের ১৯ জুন থেকে বাংলা একাডেমীর সুপারিশ করা পঞ্জিকাই অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর তখন থেকেই গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালন করা হচ্ছে।
স্বাধীনতা পূর্ব রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার প্রতিবাদে ১৯৬৭ সালে রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ উদাযাপনের আয়োজন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। রবি ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানের মধ্যে দিয়ে স্বাগত জানায় বৈশাখকে। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। ১৯৭২ সালের পর থেকেই মূলত এটি জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃত হয়। ১৯৮০ সালে এই উৎসবকে আরো এক ধাপ বাড়তি রংয়ের ছোঁয়া দিতে প্রচলন হয়েছে বৈশাখী শোভাযাত্রার। পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান বৈশাখী মেলা। কোনো কোনো জায়গায় এই মেলা চলে পুরো সপ্তাহ জুড়ে। এক হিসেবে দেখা গেছে, সারা বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ ও বৈশাখের প্রথম সপ্তাহে প্রায় হাজার দুইয়েক মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
সবচেয়ে রঙচঙে ও আনন্দঘন নববর্ষ উদযাপিত হয় ঢাকায়। হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয় রমনার বটমূলে। ছায়ানটের শিল্পীরা বৈশাখের আগমনী গান গেয়ে স্বাগত জানান নববর্ষকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলায় একই ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-ছাত্ররা মিলে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। এদিন শহীদ মিনার, টি.এস.সি এবং চারুকলা সহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিণত হয় এক বিশাল জনসমুদ্রে। এসব মেলায় পাওয়া যায় স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারূপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব ধরণের হস্তশিল্প ও মৃৎশিল্পজাত, মানে মাটির সামগ্রী। এ ছাড়া শিশু-কিশোরদের খেলনা, মেয়েদের সাজসজ্জার সামগ্রীসহ আরো কতো কিছু পাওয়া যায় এই মেলায়। এছাড়াও রকমারি লোকজ খাদ্যসামগ্রী, যেমন, চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা ও বিভিন্ন প্রকার মিষ্টির বৈচিত্র্যময় সমারোহ থাকে মেলায়। আর পান্তা- ইলিশ বৈশাখী মেলার প্রধান আকর্ষণে পরিনত হয়েছে বাংলাদেশের সব জেলায়।
পহেলা বৈশাখ নিয়ে অনেক কথা বলা হল, এর সাথে জড়িত রয়েছে চৈত্র সংক্রান্তি নামক আরেকটি অনুষ্ঠান। চৈত্র সংক্রান্তি পহেলা বৈশাখের মতই বাংলার আরেক চিরায়ত উৎসব। নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উৎসব হল পহেলা বৈশাখ আর পুরোনো বছরকে বিদায় জানানোর উৎসব হল এই চৈত্র সংক্রান্তি। বছরের শেষ মাস চৈত্র, আর সেই মাসের শেষ দিন, মানে বছরেরই শেষ দিনে হয় এই উৎসবটি। এই দিনে গ্রামেগঞ্জে গান বাজনার মাধ্যমে পুরোনো বছরকে বিদায় জানানো হয়। শুধু তাই নয়, নতুন বছরের জন্য শুভকামনাও করা হয় এই আয়োজন থেকে। চৈত্র মাসের শেষ বিকেল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত শহরের নানা জায়গায় উৎসব হয়।
বাংলাদেশের তিনটি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি অঞ্চলে বাংলা নববর্ষ ও চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা আয়োজন করেন ‘বৈসাবি’। বৈসাবি হলো ওখানকার সবচেয়ে বড় উৎসব। এই বৈসাবি কিন্তু উৎসবটির আসল নাম নয়। চাকমাদের বর্ষবরণ উৎসবের নাম বিজু। মারমাদের উৎসবের নাম সাংগ্রাইং, আর ত্রিপুরাদের উৎসবের নাম বৈসুক। বৈসুক, সাংগ্রাইং ও বিজু- এই তিনটির নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে তৈরি করা হয়েছে বৈসাবি শব্দটি। তাই ওই অঞ্চলের বর্ষবরণ উৎসবকে একসঙ্গে এখন বলা হয় বৈসাবি। বছরের শেষ দুই দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন, এই তিনদিন মিলেই বৈসাবির মূল আয়োজন। পুরনো বছরকে বিদায় দিতে এবং নতুন বছরকে বরণ করতে সেই আদি কাল থেকেই পালন করে আসছে পাহাড়িরা এই উৎসব। এদিন তারা বিভিন্ন খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আদিবাসী মেলার আয়োজন করে।
আজ এখানেই সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা।
মোঃ মোশাররফ হোসাইন উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।