বৈষম্য ও টেকসই উন্নয়ন (Inequality and sustainable development)
(লেখক- ড. মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন, পরিচালক, ইউএসটিসি রিসার্চ সেল এবং সহযোগী অধ্যাপক, অর্থ ও ব্যাংকিং বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অফ সাইন্স এন্ড টেকনোলজি চিটাগাং (ইউএসটিসি).
email: dr.sahabuddin@ustc.ac.bd).
ভূমিকা
বৈষম্যের বাংলায় সমার্থক শব্দ হচ্ছে গোঁড়ামি, পক্ষপাতিত্ব, ঘৃণা, বৈষম্য, অবিচার, অসহিষ্ণুতা, কুসংস্কার, অন্যায্যতা এবং ইংরেজি সমার্থক শব্দ হচ্ছে Abhorrence, Bigotry, Contraposition,Discrimination, Dissimilarity, Imparity, Inequality, , Injustice, Intolerance, Odd, Prejudice, Relief, Unfairness, and Variances । সহজ ভাষায় বলতে গেলে কারো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যদি তাকে ওই পদ, হিস্সা বা অংশ থেকে বঞ্চিত করা হয় তাকে বৈষম্য বলে । বৈষম্যে বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন, অর্থনৈতিক বৈষম্য: ধনী ও গরিবের মধ্যে সম্পদের অসম বণ্টন; শিক্ষাগত বৈষম্য: শিক্ষার সুযোগ বা মানের পার্থক্য; লিঙ্গ বৈষম্য: নারী-পুরুষ বা অন্যান্য লিঙ্গ পরিচয়ের ব্যক্তিদের প্রতি অসম আচরণ; সামাজিক বৈষম্য: জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বংশ বা সামাজিক শ্রেণির ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক আচরণ; প্রযুক্তিগত বৈষম্য: ডিজিটাল ডিভাইস বা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগের অসমতা । বৈষম্য কারণে সমাজে বা কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ব্যক্তিদের মধ্যে কেবল অসমতা বা অনৈতিক পার্থক্য সৃষ্টি করে না বরং ক্ষমতার পালাবদল হতে পারে এমনকি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে এবং নিকট অতীতে আমাদের সেই অভিজ্ঞতাও রয়েছে।
বৈষম্য টেকসই উন্নয়নে প্রধান বাধা-
টেকসই উন্নয়ন (Sustainable Development) এমন একটি ধারণা যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং পরিবেশ সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার উপর গুরুত্ব দেয়। তবে, বৈষম্য টেকসই উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত দিক থেকে বৈষম্য সমাজের অগ্রগতিকে ব্যাহত করে এবং দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে ।
অর্থনৈতিক বৈষম্য-
অর্থনৈতিক বৈষম্য (Economic Inequality) টেকসই উন্নয়নে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ । যখন সম্পদ সীমিতসংখ্যক মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে, তখন বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় । এটি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামোতে বিনিয়োগের সুযোগ কমিয়ে দেয়, ফলে সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধীর হয়ে যায় । পাশাপাশি, উচ্চ মাত্রার বৈষম্য দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বৃদ্ধি করে, যা আর্থিক শৃঙ্খলা নষ্ট করে এবং সমাজে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়, যা দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের জন্য একটি বড় বাধা হিসাবে কাজ করে । সত্যিকারের টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অথবা কল্যাণকর অর্থনৈতিক (Welfare Economic) ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি ।
সামাজিক বৈষম্য-
সামাজিক বৈষম্য সমাজে অসংহতি তৈরি করে এবং সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করে । শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং মৌলিক অধিকারগুলোতে অসাম্য তৈরি করে মানুষের উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে । নারীদের প্রতি বৈষম্য, জাতিগত ও ধর্মীয় বৈষম্য সমাজের বড় অংশকে পিছিয়ে রাখে, যা সামগ্রিক অগ্রগতিকে ব্যাহত করে ।
রাজনৈতিক বৈষম্য-
রাজনৈতিক বৈষম্য বলতে আমরা রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের অভাবকে বুঝি । অনেক দেশেই রাজনৈতিক ক্ষমতা একটি ছোট গোষ্ঠীর বা পরিবারের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে । এই অসমতা জনগণের চাহিদা ও প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করে । রাজনৈতিক বৈষম্য দূর না হলে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, যা টেকসই উন্নয়নের জন্য বড় বাধা হিসাবে কাজ করে।
পরিবেশগত বৈষম্য-
বৈষম্য পরিবেশগত সমস্যারও অন্যতম কারণ । ধনী দেশ ও ব্যক্তি বেশি পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে এবং অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ ঘটায়, যেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের শিকার হয় । তারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হওয়ার কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না । ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি তুলনামূলকভাবে বেশি হয় ।
বৈষম্য দূর করার উপায়
বৈষম্য সমাজের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হয় । এটি দূর করার জন্য নীতি, আইন ও সামাজিক সচেতনতা একান্ত প্রয়োজন । বৈষম্য কমানো এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য কিছু কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে:
অর্থনৈতিক নীতি পুনর্গঠন: সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে । ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান কমাতে প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা চালু করা ।
সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: লিঙ্গ, বর্ণ, ধর্ম, জাতি ইত্যাদি ভিত্তিতে বৈষম্য দূর করতে হবে। নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা ।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সমান সুযোগ: মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে সব শ্রেণির মানুষকে সমান সুযোগ প্রদান ।
অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি: রাজনীতি ও প্রশাসনে সকল শ্রেণির মানুষের মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ।
পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ: টেকসই পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য ন্যায়সঙ্গত ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ । হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় দরিদ্র দেশগুলিকে সহায়তা করতে হবে ।
উপসংহার
বৈষম্য দূর করা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয় । এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও পরিবেশগত সুরক্ষাকে দুর্বল করে দেয় । তাই সরকার, প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি ন্যায়সঙ্গত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তুলতে হবে । বৈষম্য হ্রাসের মাধ্যমেই আমরা একটি টেকসই ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারি । আর সে জন্য প্রয়োজন একটি হোলিস্টিক এপ্রোচ (Universal Approach) টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হোলিস্টিক এপ্রোচ (Holistic Approach) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে। এটি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত বিষয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে, যা সকল অংশীজনের (Stakeholders) জন্য দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণ নিশ্চিত করে।