মোঃ মোশাররফ হোসাইন উপজেলা নির্বাহী অফিসার সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়াঃ
খ্রিস্টান ধর্মাম্বলীদের অন্যতম বড় উৎসব ‘ক্রিসমাস’ বা বড়দিন। বড়দিনের সাথে দিনের দৈর্ঘের কোনো সম্পর্ক নেই। বড়দিন হলো যিশুর জন্মদিন এবং একটি বাৎসরিক খ্রিস্টীয় উৎসব। ২৫ ডিসেম্বর তারিখে যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে এই উৎসব পালিত হয়। এই দিনটিই যিশুর প্রকৃত জন্মদিন কিনা তা জানা যায় না। আদিযুগীয় খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুসারে, এই তারিখের ঠিক নয় মাস পূর্বে মেরির গর্ভে প্রবেশ করেন যিশু। সম্ভবত, এই হিসাব অনুসারেই ২৫ ডিসেম্বর তারিখটিকে যিশুর জন্মতারিখ ধরা হয়। রোমানদের তথ্য অনুসারে, বেথলেহেম শহরে এই দিনেই মেরির কোলে জন্ম হয় যিশুর। সেই থেকেই দিনটিকে ‘বড়দিন’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। গ্রিক বর্ণমালা এবং পশ্চিম বঙ্গের আকাডেমির বাংলা অভিধানে ‘বড়দিন’-এর অর্থ পাওয়া যায়। এছাড়াও দিনটির ইতিহাস সম্পর্কে জানতে কোথাও কোথাও এর ভৌগলিক ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। সেই তথ্য অনুসারে, যিশুখ্রিস্টের জন্মমাস বলেই পুরো মাসকে ‘খ্রিস্টমাস’ বলা হয়। সেখান থেকেই এসেছে খ্রিস্টের মাস। আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে রচিত একটি বই থেকে জানা যায়, মধ্যযুগীয় সময়ের ইংরেজি Christemasse বা Cristes Messশব্দ থেকে এসেছে ‘খ্রিস্টমাস’। এই “Cristes” শব্দটি এসেছে গ্রিক Christos এবং “Mess” শব্দটি লাতিন missa থেকে। গ্রিক ভাষায় “X” কথাটির অর্থ হলো Christ। তাই খ্রিস্টের সংক্ষিপ্ত শব্দ হিসেবে এই ‘X-Mas’ কথাটি বলা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড: বিশ্বজিৎ ঘোষ এর মতে, বড় শব্দের নানারকম অর্থ আছে। আমরা যখন বলি, ‘বড়মানুষ’ সেটা আমরা মহৎ মানুষ অর্থে ব্যবহার করি। ক্রিসমাস যে কে বাংলায় বড়দিন বলা হয় সেটি ‘লঙ ডে’ বা লম্বা দিন অর্থে নয়। ‘গ্রেট ডে’ বা মহৎ একটা দিন অর্থে। আরেকটু স্পষ্ট করে বলতে হলে, ২৫ ডিসেম্বর এমন একজন জন্মগ্রহণ করেছেন যিনি কেবল সুনির্দিষ্ট একটি ধর্মের না মানবসভ্যতার ইতিহাসে অনন্য। এদিন তার জন্ম বলে এদিন মহৎদিন। তাই মর্যাদার দিক থেকে এটি একটি বড়দিন।’ ইতিহাস বিশ্লেষণ করে বিশ্বজিৎ ঘোষ আরও বলেন, আঠার ও উনিশ শতকে ইউরোপীয়রা এসে এ অঞ্চলে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার করে। সেসময় থেকে যারা ধর্মটি গ্রহণ করেছেন তাদের কাছে এটি আরও মহিমান্বিত বিষয়। নানা কারণে বাঙালি যারা খ্রিস্টান ধর্মে রূপান্তরিত
হয়েছেন তারা ভাবেন যিশু এমন একজন যিনি তাকে ধর্ম দিয়েছেন। তাই তার জন্মদিনটাই তারা সব আবেগ দিয়ে পালন করেন। এ কারণেই দিনটি তাদের কাছে বড়দিন হিসেবে বিবেচিত।
অনেক সমালোচকের মতে, বড়দিনের সাথে দিনের দৈর্ঘের কোনো সম্পর্ক নেই। এর কারণ লুকিয়ে আছে পরাধীন ভারতবর্ষের সময়ে। বড়দিন নামকরণও সেই পরাধীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের সময় থেকেই। এই দিনটি আসলে ইংরেজদের জন্য সেরা তাই এইদিনটিকে “সাহেবের বড়দিন” বা “বড়দিন ” বলে সম্বোধন করা হয়। কেননা অবিভক্ত ভারতবর্ষে যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ছিল, তখন ভারতবাসী দেখেছে এই দিনে সাহেব অর্থাৎ ইংরেজ তথা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তারা প্রচুর হৈহুল্লোড় করে থাকে , মদ-মাংস আর কেক কাটার মাধ্যমে দিনটিকে ইংল্যান্ডের লোকেরা পালন করে থাকতেন। সেই থেকেই দিনটি বড়দিন নামে পরিচিত বলে একদল মানুষের ধারণা।
২৫ ডিসেম্বর দিনটিকে ‘বড়দিন’ আখ্যা দেওয়ার পেছনে ভৌগলিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। উত্তর গোলার্ধের দক্ষিণ অয়নান্ত দিবসেও দেখা হয়। অর্থাৎ ২৩ ডিসেম্বর থেকে দিন বড় হতে থাকে, অন্যদিকে রাত হতে থাকে ছোট। তাই ২৫ ডিসেম্বরকে ‘বড়দিন’ বলে আখ্যা দেন দার্শনিকরা। দার্শনিকদের মতে, মর্যাদার দিক থেকে এটি একটি ‘বড়দিন’। তাই এই নামকরণে যুক্তিও রয়েছে। “The Origins of Christmas” বই থেকে জানা যায়, ২৫ ডিসেম্বরকে ‘বড়দিন’ হিসাবে পালন করার প্রথা শুরু করেন রোমানরা। রোমান রাজা অরেলিয়ান এই দিনে মহাসমারোহে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন শুরু করেন। বিশ্বজুড়ে তাই ২৫ ডিসেম্বরকেই ‘বড়দিন’ হিসেবে পালিত হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘বড়দিন’ একই দিনে অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বর বড় দিন পালন হলেও রাশিয়া, জর্জিয়া, মিশর, আর্মেনিয়া, ইউক্রেন ও সার্বিয়ার মতো কয়েকটি দেশে এই উৎসব পালিত হয় ৭ জানুয়ারি। জুলিয়ান বা জর্জিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসাব মেনেই এসব দেশে উৎসবটি পালিত হয়। শুধু তাই হয়, আর্মেনিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারীরা ৬ জানুয়ারি ‘বড়দিন’ পালন করেন। ‘বড়দিন’ পালন নিয়ে তাই অনেক মতবেদ রয়েছে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে নানা মতভেদের থাকলেও ২৫ ডিসেম্বরেই উৎসবটি মহাসমারোহে পালিত হয় বিশ্বজুড়ে। এই দিনেই আনন্দ, উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেন সবাই।
খ্রিস্টান ধর্মাম্বলীদের সবচেয়ে বড় উৎসব বড়দিন। বিশ্বজুড়ে আলোকসজ্জায় নানা আয়োজনে উৎসবটি পালিত হচ্ছে। সান্তাক্লজ, ক্রিসমাস ট্রি সেজে উঠেছে সব গীর্জায়। প্রার্থনা শেষে দিনের শুরুতেই ‘মেরি ক্রিসমাস’ বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন খ্রিস্টান ধর্মাম্বলীরা। ‘বড়দিন’এর শুভেচ্ছো বিনিময়ে মেরি ক্রিসমাস বলার পাশাপাশি ‘এক্স-মাস’ও বলা হয়। যদি কেউ ‘হ্যাপি ক্রিসমাস’ বলেও বসেন, তবে অন্যরা ভুল ধরিয়ে বলেন, ‘হ্যাপি নয়, মেরি ক্রিসমাস।’ এই সম্বোধনটা কেন করা হয় তা জানেন? ইংল্যান্ডে ব্যাপকভাবেই ক্রিসমাসের আগে ‘হ্যাপি’ই বসানো হয়। ব্রিটেনের রানি নিজেও বড়দিনের শুভেচ্ছা জানাতে ‘হ্যাপি ক্রিসমাস’ বলেন। রানির মতে, ‘মেরি’টা যথেষ্ট পরিমাণে ভদ্র শব্দ নয়। ১৫৩৪ সালে বিশপ জন ফিশার চিঠি লিখেছিলেন ক্রোমওয়েলকে। সেই চিঠিতে জন ফিশার ‘মেরি ক্রিসমাস’ লিখেই সম্বোধন করেছেন।বলা যায়, সাধারণ মানুষের শুভেচ্ছা বিনিময়ে ভাষা হচ্ছে ‘মেরি ক্রিসমাস’। অন্যদিকে রক্ষণশীলদের ক্রিসমাস শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভাষা হচ্ছে ‘হ্যাপি ক্রিসমাস’। বিশ্বজুড়ে এমন চিত্র খুব কম দেখা গেলেও ইংল্যান্ডের রীতিতে এই প্রথাই চলছে। উনিশ শতকের গোড়া থেকে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ‘মেরি ক্রিসমাস’ই শুভেচ্ছাবার্তা হিসাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ক্রিসমাস-কার্ডেও এই কথাটিই ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়। যা এখন বিশ্বের খ্রিস্টান ধর্মাম্বলীদের কাছে প্রধান শুভেচ্ছাবার্তা হয়ে উঠেছে।
উৎস: ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট ও বই থেকে সংগৃহীত ও সংকলিত।