গোমতী নদী: কুমিল্লার দুঃখ।
ত্রিপুরাসহ উত্তর–পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অংশে টানা তীব্র বৃষ্টিপাতের কারণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে এবং পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে অবনতি হচ্ছে। অনবরত বৃষ্টিপাতের ফলে ত্রিপুরা রাজ্যের হাওড়া, খোয়াই, মুহুরী ও ঢলাইসহ রাজ্যের প্রায় সব নদীর পানিই বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতেই ত্রিপুরার ডম্বুর হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট বা ডম্বুর গেট খুলে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এই বাঁধ খুলে দেয়ায় ভারতের পানি ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশের কুমিল্লায়। দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় ধরে এই বাঁধ খোলেননি ভারত কতৃপক্ষ। সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে খুলে দিয়েছিল ভারত। ত্রিপুরা রাজ্যের “গোমতী জেলার জেলাশাসক তরিৎ কান্তি চাকমা তার সরকারি এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যাণ্ডেলে জানিয়েছেন যে, গোমতী নদীতে জলস্তর বেড়ে যাওয়ার ফলে ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধের জলস্তরও বিপদসীমা ছুঁয়ে ফেলেছিল। বাঁধ বাঁচাতে গেট খুলে জল ছেড়ে দিতে হয়েছে (বিবিসি বাংলা)।”
চাকরির সুবাদে বর্তমানে কুমিল্লায় পদায়ন থাকায় সরাসরি দেখার সুযোগ হচ্ছে উত্তাল গোমতী নদীকে। এই গোমতী কে বলা হয় কুমিল্লার দুঃখ। নদীটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর-পূর্বপ্রান্তীয় পার্বত্য অঞ্চল ডুমুর নামক স্থান থেকে উৎপন্ন হয়ে পার্বত্যভূমির মধ্য দিয়ে ১৫০ কিমি সর্পিল পথ অতিক্রম করে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার বিবিরবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ ভূখন্ডে প্রবেশ করেছে। সীমান্তবর্তী কটকবাজার থেকে নদীটি কুমিল্লা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রবেশের পর এটি আঁকাবাঁকা প্রবাহপথে কুমিল্লা শহরের উত্তর প্রান্ত এবং ময়নামতীর পূর্ব প্রান্ত অতিক্রম করে বয়ে চলেছে। এটির প্রবাহপথের উত্তর দিকে বুড়িচং উপজেলাকে ডানে রেখে এটি দেবিদ্বার উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কোম্পানীগঞ্জ বাজারে পৌঁছেছে। ময়নামতি থেকে কোম্পানীগঞ্জ বাজার পর্যন্ত নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ কিলোমিটার। এবং কোম্পানীগঞ্জ থেকে পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়ে নদীটি শেষাবধি দাউদকান্দি উপজেলার শাপটা নামক স্থানে এসে মেঘনা নদীতে পতিত হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ এবং দাউদকান্দির মধ্যে নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত। বাংলাদেশ ভূখন্ডে গোমতী নদীর মোট দৈর্ঘ্য ১৩৫ কিমি।
গোমতী নদী তীব্র স্রোত সম্পন্ন একটি পার্বত্য নদী। বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টিপাতের সময় কুমিল্লায় প্রবেশপথে প্রবাহ মাত্রা ১০০ থেকে ২০,০০০ কিউসেক পর্যন্ত উঠানামা করে। নদীটির বর্ষাকালীন গড় প্রশস্ততা প্রায় ১০০ মিটার। এ সময়ে নদীটির কানায় কানায় পূর্ণ থাকে এবং স্রোতও হয় দ্রুতগতি সম্পন্ন। কিন্তু শীতের মৌসুমে এর গতিধারা সংকীর্ণ হয়ে আসে এবং এর অধিকাংশ স্থানে হেঁটেই নদী পার হওয়া যায়। স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের বছরে নদীর পানির উচ্চতা পার্শ্ববর্তী এলাকার স্তর থেকে ১.৫ মিটারের উপরে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। আকস্মিক বন্যা এ নদীর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য এবং এ বন্যা মোটামুটি নিয়মিত বিরতিতে সংঘটিত হয়ে থাকে। এজন্য এ নদী একসময় ‘কুমিল্লা শহরের দুঃখ’ হিসেবেই পরিচিত ছিল। টিক্কারচর সংলগ্ন শুভপুর থেকে কাপ্তানবাজারের শেষ মাথা পর্যন্ত গোমতির অংশটি তৎকালীন শহরকে প্লাবিত করে ক্ষতিগ্রস্ত করত বিধায় ষাটের দশকে দুই তীর উচু করে বেধে বর্তমান গোমতীর প্রবাহ সৃষ্টির মাধ্যমে শহর ও দুই তীরের জনপদকে রক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়। সে সময়েই শুভপুর থেকে কাপ্তানবাজার পর্যন্ত স্রোতহীন অংশটি পুরাতন গোমতি হিসেবে নামকরণ লাভ করে।
গোমতী নদীর ধ্বংসাত্মক প্রবণতা প্রতিরোধে এবং কুমিল্লা শহর রক্ষায় সরকারিভাবে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বন্যা প্রতিরোধের জন্য ভেড়িবাঁধ এবং নদীর গতিপথ সোজা রাখতে ১৯টি লুপকাট নির্মাণ করেছে। এসকল ব্যবস্থা গৃহীত হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন সময় বন্যার প্রকোপে কুমিল্লা শহর বিপদাপন্ন হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক গৃহীত আরও কিছুসংখ্যক প্রকল্প বাস্তবায়নের পর, বর্তমানে গোমতী নদীর দৃশ্যত নিয়ন্ত্রণাধীন। নদীটিতে বৃহৎ কোনো নৌকা চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় নাব্যতা নেই। কুমিল্লা, বুড়িচং, ময়নামতী, কোম্পানীগঞ্জ, মুরাদনগর এবং দাউদকান্দি এ নদীর তীরবর্তী উল্লেখযোগ্য স্থান। দাউদকান্দি পর্যন্ত গোমতীর জোয়ারভাটা প্রভাবাধীন, কিন্তু উজান অঞ্চলে জোয়ারভাটার প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না এই নদীতে।
লেখকঃমোঃ মোশারফ হোসাইন সিনিয়র সহকারী সচিব,ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা কুমিল্লা জেলা প্রশাসন কার্যালয়।