নৌকা বাইচ: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলায় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অনুসঙ্গ।
মো: মোশারফ হোসাইন।
সহকারী কমিশনার (ভূমি), ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীকে কেন্দ্র করে প্রস্ফুটিত হয়েছে শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বিকাশ। এজন্য দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও খেলাধুলায় নদ-নদীর উপস্থিতি প্রবল।ভৌগলিকভাবে শতশত নদ-নদী পরিবেষ্টিত এদেশের মানুষের বর্ষা মৌসুমে একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। আর এই নৌকাকে ঘিরেই জমে উঠত সারা বছর ব্যাপী আনন্দ উৎসবের নানা অনুসঙ্গ। আনন্দ উৎসবের এই ধারাবাহিকতায় নৌকা বাইচ গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে পরিণত হয়েছে লোকালয় সংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ ফসল।
আবহমান বাংলার লোক ঐতিহ্যের এই নৌকা বাইচ বর্তমান সভ্য সমাজেও সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে পরিচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলার মানুষ কৃষ্টি ধারণে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। আধুনিকতার ছোঁয়ায় অন্যান্য জেলার ন্যায় এই জেলাতেও নানা রকম লোক কৃষ্টি বিস্মৃত হয়ে জীবনযাত্রায় এসেছে অনেক পরিবর্তন ও বিবর্তন। তাই আগের মতো নৌকাবাইচ এই জেলায় ততটা জমে উঠত না। তবে জেলা প্রশাসন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্যোগে নৌকা বাইচের মতো ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরা হচ্ছে জেলাবাসীর নিকট। কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যেতে বসলেও বর্তমান জেলা প্রশাসক মোঃ শাহগীর আলম মহোদয়ের একান্ত প্রচেষ্টায় গত বছর থেকে আবার নতুন করে শুভ সূচনা হয়েছে নৌকা বাইচের। জেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগের ফলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সকল স্তরের আবাল বৃদ্ধ বনিতা নতুন উদ্যমে মেতে উঠেছে বাঁধ ভাঙা উল্লাসে। এবছর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আগামী ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রি. তারিখে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ এর স্মৃতি বিজড়িত তিতাস নদীতে অনুষ্ঠিত হবে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা।
নৌকা বাইচ এর সঠিক ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে গবেষণা হলেও এখনো পর্যন্ত এর সঠিক ইতিহাস বের করা সম্ভব হয়নি। ভাষাতত্ত্ববিদদের মতে, বাইচ শব্দটি ফার্সি এবং এর অর্থের বিবর্তনের ক্রম হলো বাজি>বাইজ> বাইচ/প্রতিযোগিতা/ খেলা। গবেষকদের মতে কালের পরিক্রমায় ইরাকের ইউফ্রেটিস নদীর তীরে গড়ে ওটা মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় শুরু করা হয় নৌকা বাইচ খেলা। ইতিহাসের বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ বছর আগে ইউফ্রেটিস নদীতে এরকম নৌকা বাইচের আয়োজন করত। এরপর এর বিস্তৃতি ঘটে মিশরের নীল নদে। বিশ্ব পরিভ্রমণের মাধ্যম এই নৌকা বাইচের আগমন ঘটে ভারতীয় ভূখণ্ডে। এই ভারতীয় উপমহাদেশে নৌকা বাইচ নিয়ে দুটি জনশ্রুতির প্রচলন রয়েছে। প্রথম জনশ্রুতিটি হলো জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা নিয়ে। এই স্নানযাত্রা উপলক্ষে স্নানার্থীদের নিয়ে বহু নৌকা নিয়ে মাঝিরা নদী পারাপারে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয় । এ থেকেও নৌকা বাইচের প্রচলন শুরু হয় মর্মে অনেকেই মনে করে। দ্বিতীয় জনশ্রুতিটি হলো হিন্দু মুসলিম সকলের কাছে সম্মানিত পীর গাজী-কালো কে কেন্দ্র করে। গাজী-কালোর ভক্তরা মেঘনা নদীর এক পাড়ে দাঁড়িয়ে অন্য পাড়ে থাকা ভক্তদের কাছে আসার আহ্বান করেন। কিন্তু ঘাটে কোন নৌকা ছিল না। ভক্তরা ওপাড়ে আসতে একটি ডিঙ্গি নৌকা খুঁজে বের করেন। যখনই নৌকাটি মাঝ নদীতে এলো তখনই নদীতে তোলপাড় আরম্ভ হয়। নদী ফুলে ফেঁপে উঠল। তখন চারপাশের যত নৌকা ছিল তারাও খবর পেয়ে নৌকা নিয়ে ছুটে আসেন। তখন সারি সারি নৌকা একে অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলে । এ থেকেই শুরু হয় নৌকা বাইচের।
ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে মুসলিম শাসন বিস্তৃত ছিল প্রায় আটশ বছর। গবেষণায় পাওয়া যায়, মুসলিম যুগের নবাব-বাদশাহগণ নৌকা বাইচের আয়োজন করতেন। অনেক নবাব বা বাদশাহদের জল বা নৌ বাহিনীর দ্বারা নৌকা বাইচ উৎসবের গোড়াপত্তন হয়। পূর্ববঙ্গের ভাটি অঞ্চলে প্রশাসনিক অন্যতম উপায় ছিল নৌশক্তি। বাংলার বারো ভুঁইয়ারা নৌবলে বলিয়ান হয়ে মুগলদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। মগ ও হার্মাদ জলদস্যুদের দমন করতেও নৌশক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। এদের রণবহরে দীর্ঘ আকৃতির ‘ছিপ’ নৌকা থাকত। সময়ের পরিক্রমায় এইসব থেকে জন্ম নেয় প্রতিযোগিতামূলক নৌকা বাইচ নাম খেলার। বাংলাপিডিয়ার মতে, বাংলাদেশে নৌকা বাইচের সংগঠন ও উন্নয়নের জন্য ১৯৭৪ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশ রোয়িং ফেডারেশন। এই ফেডারেশন সনাতন নৌকা বাইচ ও রোয়িং-এর মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। এই ফেডারেশন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রোয়িং ফেডারেশনের সদস্য। দেশীয় নৌকা বাইচকে উৎসাহিত করার জন্য প্রতি বছরই অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে জাতীয় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়, এছাড়াও ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
নৌকা বাইচের নৌকা হয় সরু এবং লম্বাটে । কারণ সরু ও লম্বাটে নৌকা নদীর পানি কেটে দ্রুত গতিতে চলতে পারে। নৌকার সামনে সুন্দর করে সাজানো হয়। কখনো ময়ূরের মুখ , কখনো রাজ হাঁসের মুখ বা পাখির ঠোঁটের অবয়ব তৈরি করে নৌকা বানানো হয়ে থাকে। এতে অতি উজ্জ্বল রং করে ফুল, লতা ,পাতা, আরও অনেক রকম জিনিস এঁকে দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে থাকেন। সিলেট অঞ্চলে সারেঙ্গী নৌকা ব্যবহার করা হয়। এর আকার কোশা ও ছিপ জাতীয় বাইচের নৌকার মতই সরু, লম্বায় ১৫০-২০০ ফুট এবং প্রস্থ প্রায় ৫-৬ ফুট হয়। নৌকা তৈরিতে সাধারণত শাল, শীল কড়ই, গর্জন, জারুল কাঠ ব্যবহার করা হয়। নৌকাগুলোর নামও রাখা হয় ভিন্ন ভিন্ন। যেমন সোনার তরী, পঙ্খীরাজ,ময়ূরপঙ্খী ইত্যাদি। নৌকা বাইচের আগে মাঝিরা প্রথমে পাক পবিত্র হয়ে বা গোসল করে নতুন গেঞ্জি আর মাথায় গামছা পরে নৌকায় উঠে। তাদের কারো কারো হাতে থাকে কাঁসর, করতাল, ঢোল, ডপকি। সবার মাঝখানে থাকেন নৌকার নির্দেশক। প্রতিটি নৌকায় ৭,২৫, ৫০, ১০০ জন মাঝি থাকতে পারেন। নৌকার দুই পাশে মাঝিরা সারি বেঁধে বসে পড়েন বৈঠা হাতে নিয়ে। একজন নৌকা পরিচালনা করার জন্য থাকেন তাকে গায়েন বলা হয়। তিনি বসে থাকেন নৌকার গলুইয়ে। মাঝিরা একত্রে নৌকা জয়ধ্বনি করে ছাড়ার সাথে সাথে সমবেত স্বরে গান ধরে থাকেন এবং ঝোঁকে ঝোঁকে বৈঠা টানতে থাকেন সেই সাথে নৌকা ও এগিয়ে যেতে থাকে। সবার নৌকা যখন ছুটতে থাকে তখন প্রতিযোগিতা শুরু হয় । কার আগে কে যেতে পারে।
নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় স্থানীয় নিয়মানুসারে। নৌকা বাইচ পরিচালনা কর্তৃপক্ষ প্রতিযোগীতার আগেই অংশগ্রহণকারী দল সমূহকে নিয়ম-কানুন সর্ম্পকে অবহিত করে থাকে এবং অংশগ্রহণকারী দল সমূহ তা মানতে বাধ্য থাকে। নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় দূরত্ব হয়ে থাকে ৬৫০ মিটার। তবে স্থানীয়ভাবে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় এই দূরত্বের কম বেশি হয়ে থাকে। প্রতিযোগিতা কত মাঝির নৌকা বাইচ হবে তা আগেই র্নিধারণ করা হয়ে থাকে; সাধারণত ২৫ অথবা ৫০ মাঝির নৌকা বাইচ হয়ে থাকে। প্রতিযোগিতায় প্রত্যেক নৌকার জন্যে আলাদা লাইন থাকে এবং এক নৌকা অন্য নৌকা থেকে ১০ মিটার দূরে অবস্থান করে থাকে। বাইচের সময় এক নৌকার মাঝিরা বিভিন্ন গান গেয়ে থাকে। বাইচের এই গানকে সারি গান বলা হয়। এ গান শ্রমিকের গান হিসাবে পরিচিত। সিলেট অঞ্চলের অনেক মরমী সাধক নৌকা বাইচ নিয়ে অসংখ্য সারি গান লিখে আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডারকে করে গেছেন সমৃদ্ধ। শাহ আব্দুল করিম লিখেছেন-আল্লার নাম, নবীর নাম লৈয়ারে; কোন মেস্তরী নাও বানাইল; মহাজনে বানাইয়েছে ময়ূরপঙ্খী নাও ইত্যাদি, হাছন রাজা লিখেছেন -ছাড়িলাম হাছনের নাওরে ; সৈয়দ শাহ নুর লিখেছেন- পাক পানি চিনিয়া নাও বাইও ; ও সোনা ভাবী গো লিখেছেন তৈমুর রাজা চৌধুরী ; এছাড়া অজ্ঞাত শিল্পীদের মধ্যে প্রচলিত গানগুলো হল – রঙ্গিলা মাঐ গো, সোনামুখীর জামাই আইছে, সোনা দাদার বৌ গো ইত্যাদি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলার প্রধান নদী হলো তিতাস। তিতাস নদীর মহিমা প্রতিষ্ঠা করেছেন তিতাস পারের সন্তান বিখ্যাত ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ। এই তিতাস নদীতে অনুষ্ঠিত নৌকা বাইচ ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর নিকট একটি বর্নাঢ্য উৎসব। আবহমান কাল থেকে জেলার মানুষের জীবনের সাথে নৌকাবাইচ ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু ভালোবাসার এই তিতাস নদীটি নাব্যতা হারিয়ে এবং দখলদারদের দখলে গিয়ে নদীটি অনেক ক্ষেত্রেই এর প্রকৃত গতিপথ হারিয়ে ফেলছে এবং কচুরিপানা দিয়ে আবদ্ধ হয়ে অনেকটা বদ্ধ ডোবায় পরিণত হয়েছিল। জেলা প্রশাসক মোঃ শাহগীর আলম মহোদয়ের নির্দেশনায় সকল উপজেলা প্রশাসন তিতাস রক্ষায় সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং সকল কচুরিপানা অপসারণ করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট। এছাড়া জেলা প্রশাসন তিতাসের অবৈধ দখলদারদের তালিকা প্রণয়ন করে উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েছে এবং বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে নিয়মিত পরিচালিত হচ্ছে মোবাইল কোর্ট। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এই তিতাস নদীতে এবার বসবে নৌকা বাইচের আসর। ঐতিহ্যবাহী লোক সংস্কৃতির এই নৌকা বাইচ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলায় চলামান সাংস্কৃতিক বিপ্লবেকে করবে আরো বেগবান।