হিজরি সনের ইতিকথা: এক নতুন পঞ্জিকা।
আজ পহেলা মহররম ১৪৪৫ হিজরি। আমাদের কতজন জানে এই আরবি নববর্ষের কথা? জানার কথাও না এবং তেমন একটা দরকার ও হয়না। যদিও মুসলিমদের ধর্মীয় রিচুয়াল গুলো হিজরি সাল কেন্দ্রীক। এর একটা বড় সুবিধা হলো বিভিন্ন সিজনে একই উৎসব পালন করার একটা সুযোগ আসে মুসলিমদের কাছে। যেমন এই বছর মহররম গরমে আসলে আগামী ৩৬ বছর পর এই সময়ে মহররম আসবে। এই নিয়ে পরে বিস্তারিত বলছি। সাধারণত কোনো বিশেষ ঘটনার স্মৃতি ধরে রাখার মন-মানসিকতা থেকে তারিখ নির্ণয়ের প্রয়োজনীয়তা থেকে এবং দিন-মাস-বছর গণনার জোর তাগিদ থেকে মানব সভ্যতার শুরু থেকেই পঞ্জিকার উদ্ভব ঘটেছে, উদ্ভব ঘটেছে সালের। তাই পৃথিবীর প্রতিটি এলাকার লোকজন আপন কাজ সম্পাদনের জন্য দিন-তারিখ ঠিক রাখতে কোনো না কোনো বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করে থাকে। যেমন বাঙালিরা যে বাংলা সাল ব্যবহার করে তা সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রচলিত। এভাবে খ্রিস্টানরা হজরত ঈসার (আ.) জন্মদিন থেকে এর গণনা আরম্ভ করে। তেমনিভাবে হিজরি সাল বিশ্বের দুইশ কোটি মুসলমানের কাছে একটি মর্যাদাপূর্ণ পুঞ্জিকা।
বর্তমানে পৃথিবীতে বর্ষ গণনার দুটো ধারা প্রচলিত আছে। যার একটির সম্পর্ক সূর্যের গতির সঙ্গে, আর অন্যটির সম্পর্ক চাঁদের গতির সঙ্গে। প্রথমটির নাম সৌর সাল আর দ্বিতীয়টির নাম চন্দ্র সাল। এই দুটো সালের প্রতি বছর ব্যবধান হয় ১০ কিংবা ১১ দিনের। সৌর সালের বছর হয় মোটামুটি ৩৬৫ দিনে, আর চন্দ্র সালের হয় ৩৫৪ দিনে। হিজরি সালের সম্পর্ক চন্দ্রের সঙ্গে।
ইসলামিক ইতিহাস অনুসারে, ৬২২ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই সেপ্টেম্বর আল্লাহর নির্দেশে হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করেন। পরবর্তিতে মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ৬২২ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ বা ১৫ জুলাইয়ের সূর্যাস্তের সময়কে হিজরী সন শুরুর সময় হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। এর ইতিহাস হলো, হজরত ওমর (রা.) খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করে লক্ষ্য করলেন যে, সরকারি নথিপত্রে তারিখ লিখতে শুধু মাসের নাম লেখা হয়। ফলে বোঝা যায় না যে এই মাস কোন বছরের। আর নিজস্ব সাল না থাকার কারণে শুধু মাসের নাম উল্লেখ করা ছাড়া কোনো বিকল্প পথ ছিল না। যথাযথভাবে তারিখ না লেখার কারণে বহু জটিলতা ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে থাকে। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রদেশের শাসনকর্তাদের কাছে পত্রাদি ও ফরমানাদিতে শুধু মাসের উল্লেখ থাকায় কোন বছরের মাস তা নির্ধারণ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।
এছাড়া হযরত ওমর (রাঃ) এর কাছে ইরাক ও কুফার গভর্নর আবু মুসা আশআরী (রাঃ) এক চিঠিতে লেখেন, “বিশ্বাসীদের নেতা আপনার পক্ষ হতে আসা শাসন কার্যের সাথে সংশ্লিষ্ট উপদেশ, পরামর্শ এবং নির্দেশ সম্বলিত বিভিন্ন চিঠিপত্র ও দলিলে কোন সন-তারিখ না থাকায় আমরা তার সময় ও কাল নির্ধারণে যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হই। অধিকাংশ সময় এসব নির্দেশনার সাথে পার্থক্য করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে বলে আপনার নির্দেশ ও উপদেশ পালন করতে যেয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে।” এ গুরুত্বপূর্ণ পত্র পাওয়ার পর হযরত ওমর (রাঃ) মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে এক পরামর্শ সভার আয়োজন করেন। খলিফা হজরত উসমান (রা.) ও হজরত আলীসহ (রা.) বিশিষ্ট কয়েকজন সাহাবির কাছে নতুন সালের ব্যাপারে পরামর্শ চাইলেন। অনেক আলোচনার পর, হজরত আলীর (রা.) পরামর্শে হিজরতের বছরকে নতুন সাল গণনার শুরু ধরে হিজরি সাল প্রবর্তিত হয়। হিজরতের ঘটনাকে স্মরণ করে হিজরী সন শুরু করার যুক্তি হলো রাসূল (সা.) এর মদীনায় হিজরত করার মাধ্যমে ইসলাম প্রসার লাভ করে, মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, মুসলিমদের শক্তিমত্তা বাড়তে থাকে, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, ইসলাম বিজয়ী শক্তিতে পরিণত হয় এবং ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বপরি হিজরতের ঘটনাকে স্মরণ করে বানানো হয়েছে বলে এ সনকে হিজরী সন বলা হয়। তবে একটা বিষয় মনে রাখা জরুরী তাহলো নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) হিজরত করেন ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল কিন্তু হিজরী সন ১৭ হিজরী সাল (৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দ) হতে হযরত ওমর (রাঃ) এর শাসন আমলে হিজরী সন গণনা শুরু হয়।
হিজরতের ঘটনা রবিউল আউয়াল মাসে ঘটলেও আরবের প্রচলিত মাস গণনার প্রথম মাস সফরে মহররমের ১ তারিখকেই হিজরি সালের শুরু হিসেবে স্থির করে এই নতুন সালের প্রবর্তন ঘোষণা করা হয়। মহররম এর অর্থ হচ্ছে অলঙ্ঘনীয় পবিত্র। এই মহররমের ১০ তারিখকে বলা হয় আশুরা। এই আশুরা সৃষ্টির আদিকাল থেকেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার নীরব সাক্ষী। প্রাচীনকাল থেকে আরব দেশে চাঁদের হিসাবে মাস গণনা করার রেওয়াজ চালু ছিল। মাসের গণনা আরবদের মাঝে থাকলেও সাল বা বর্ষ গণনার রীতি তাদের মধ্যে ছিল না। আরব দেশে প্রাচীনকালে ১২টি মাসের মধ্যে সফর, আউয়াল, রজব, জিলকদ, জিলহজ এই চারটি মাসকে বলা হতো আল মহররম অর্থাৎ অলঙ্ঘনীয় পবিত্র। এ চারটি মাসে সব ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, মারামারি-খুনাখুনি থেকে তারা বিরত থাকত। পরবর্তীকালে আরবি মাসগুলোর প্রথম মাস সফরে আউয়ালকে মহররম নামকরণ করা হয়।
৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিজরি সাল প্রবর্তিত হলে তার এক বছরের মধ্যে তা আমাদের এই উপমহাদেশে চলে আসে আরব বণিকদের হাত ধরে। হিজরি সাল প্রবর্তনের বছর বা তার পরের বছর এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয় এবং হিজরি সালও স্বাভাবিকভাবে আমাদের দেশে প্রচলিত হয়। এই হিজরি সাল আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় সাল হিসেবেও প্রচলিত হয়েছিল, যা ৫৫৬ বছর স্থায়ী হয়েছিল। এখনও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে হিজরি সালের প্রভাবই বেশি।